ভূমিকাঃ- সত্যের
সন্ধান
রচনাকাল ১১.৩.১৩৫৯ – ২০.৪.১৩৫৯
প্রকাশকাল [প্রথম সংস্করণ] কার্তিক ১৩৮০
প্রথম সংস্করণের ভূমিকাঃ-
এলোমেলোভাবে মনে যখন প্রশ্ন উদয় হইতেছিল, তখন তাহা লিখিয়া রাখিতেছিলাম, পুস্তক প্রণয়নের জন্য নহে, স্মরণার্থে। ওগুলি আমাকে ভাসাইতেছিল অকুল চিন্তা-সাগরে এবং আমি ভাসিয়া যইতেছিলাম ধর্মজগতের বাহিরে।
১৩৫৮ সালের ১২ই জৈষ্ঠ। বরিশালের তদানীন্তন ল-ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ও তবলিগ জামাতের আমির জনাব এফ. করিম. সাহেব আমাকে তাঁহার জামাতভূক্ত করার মানসে সদলে হঠাৎ তসরিফ নিলেন আমার বাড়ীতে। তিনি আমাকে তাঁহার জামাতভূক্তির অনুরোধ জানাইলে আমি তাঁহাকে বলিলাম যে ধর্মজগতে এরুপ কতগুলো নীতি, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি এবং ঘটনার বিবরণ প্রচলিত আছে, যাহা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নহে এবং ওগুলি দর্শন ও বিজ্ঞান এই তিনটি মতবাদের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে চিন্তা করিতে যাইয়া আমার মনে কতগুলি প্রশ্নের উদয় হইয়াছে এবং হইতেছে। আমি এগুলো সমাধানে অক্ষম হইয়া এক বিভ্রান্তির আঁধার কূপ হইতে উদ্ধার করিতে পারিলে আমি আপনার জামাতভূক্ত হইতে পারি। জনাব করিম সাহেব আমার প্রশ্নগুলি কি, তাহা জানিতে চাহিলে আমি আমার প্রশ্নের একখানা তালিকা (যাহা অত্র পুস্তকের ‘সূচীপত্র’ রুপে লিখিত আছে সেই রূপেই) তাঁহাকে প্রদান করিলাম। তিনি উহা পাঠ করিলেন এবং সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেলেন, আর বলিয়া গেলেন – “কিছুদিন বাদে এর জওয়াব পাবেন”।
করিম সাহেবকে প্রদত্ত তালিকার প্রশ্নের ব্যাখ্যা ছিল না। ফৌজদারী মামলার জবাবদিহি করিবার উদ্দেশ্যে আমাকে প্রশ্নগুলির কিছু ব্যাখ্যা লিখিতে হয়। সেই ব্যাখ্যা লিখাই হইল এই পুস্তক রচনার মূল উৎস। নির্দোষ প্রমাণে মামলা চূড়ান্ত হইলে ঐগুলিকে আমি পুস্তক আকারে গ্রন্হিত করিলাম। গ্রন্হনায় আমাকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা দান করিয়াছিল স্নেহাস্পদ মো. ইয়াছিন আলী সিকদার।
এই পুস্তকখানার সম্পাদনা সম্পর্কে নানাবিধ উপদেশ, ভ্রম সংশোধন, এলোমেলো প্রশ্নগুলিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শ্রেণীবিভাগ করিয়াছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেব।
এই পুস্তকখানার সম্পাদনা শেষ হইয়াছিল বিগত ১৩৫৮ সালে। কিন্তু নানা কারণে এযাবত প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই। বর্তমানে ইহার কোন কোন কালের অংশের কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিয়া প্রকাশ করা হইল। বর্ধিত অংশের ভ্রমাদি সংশোধনের শ্রম স্বীকার করিয়াছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মুহাম্মদ শামসুল হক সাহেব এবং প্রকাশনায় আর্থিক সাহায্যপ্রদান করিয়াছেন মাননীয় অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই সাহেব। এতদকারণে সহযোগীদের নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ।
বিনীত
গ্রন্হাকার
লামচরি, বরিশাল
২০ শ্রাবণ, ১৩৮০
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1793#sthash.7gGOun2L.dpuf
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকাঃ-
‘সত্যের সন্ধান’ পুস্তিকাখানা প্রকাশিত হইলে ইহা সুধীমহলে সমাদৃত হয়, বহু পত্র-পত্রিকায় প্রশংসামূলক সমালোচনা হইতে থাকে এবং বইখানার জন্য বাংলাদেশ লেখক শিবির আমাকে ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করে [৮.৫.১৯৭৯]।
আশা ছিল যে, ‘সত্যের সন্ধান’ পুস্তিকাখানার দ্বিতীয় মুদ্রণ সম্ভব হইলে তাহাতে কিছু নতুন তত্ত্ব জানার জন্য কিছু নতুন প্রশ্ন পরিবেশন করিব, কিন্তু নানা কারণে তাহা আর সম্ভব হইল না। এই বইখানা প্রথম প্রকাশের ব্যাপারে আমাকে যে সমস্ত প্রতিকূল অবস্হার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল এবং বর্তমানেও হইতেছে – আমি আশা করি যে, আমার লিখিত ‘মুক্তমন’ নামীয় পুস্তকখানার ‘ভূমিকা’-এ তাহা ব্যক্ত করিব। তবে সামান্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন যাহা করা হইল, তাহার মধ্যে ‘ঈশ্বর কি দয়াময়?’ শীর্ষক একটি প্রশ্ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) সরদার ফজলুল করিম সাহেবের লিখিত (সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত) একটি অভিমত ছাড়া আর কিছুই উল্লেখযোগ্য নহে। কালোপযোগী পরিবর্তন করা গেল না সময়ের অভাবে।
‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা প্রণয়নকালে ইহার একটি উপনাম দেওয়া হয়েছিল ‘যুক্তিবাদ’। কিন্তু বর্তমানে সুধীমহল এ পুস্তিকাখানাকে দর্শন শ্রেণীভূক্ত করায় ইহার উপনাম দেওয়া হইল লৌকিক দর্শন।
বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে এ পুস্তিকাখানার পুন:প্রকাশ আমার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হইত না – ঢাকাস্হ বর্ণমিছিল প্রেসের অধিকারী তাজুল ইসলাম সাহেবের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া। আমি তাঁহার নিকট শুধু কৃতজ্ঞই নহি, অপরিশোধ্য ঋণে ঋণী।
আরজ আলী মাতুব্বর
১৮ জৈষ্ঠ্য ১৩৯০
০১.মূলকথাঃ-
[প্রশ্নের কারণ]
অজানাকে জানার স্পৃহা মানুষের চিরন্তন। বাক্যস্ফুরণ আরম্ভ হইলেই শিশু প্রশ্ন করিতে থাকে এটা কি? ওটা কি? বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে, কলেজে ও কাজে-কর্মে অনুরূপ প্রশ্ন চলিতে থাকে এটা কি, ওটা কি, এরূপ কেন হইল, ওরূপ কেন হইল না ইত্যাদি। এই রকম ‘কি’ ও ‘কেন’র অনুসন্ধান করিতে করিতেই মানুষ আজ গড়িয়া তুলিয়াছে বিজ্ঞানের অটল সৌধ।
প্রশ্নকর্তা সকল সময়ই জানিতে চায় সত্য কি? তাই সত্যকে জানিতে পারিলে তাহার আর কোন প্রশ্নই থাকে না। কিন্তু কোন সময় কোন কারণে কোন বিষয়ের সত্যতায় সন্দেহ জাগিলে উহা সম্পর্কে পুনরায় প্রশ্ন উঠিতে থাকে।
কোন বিষয় বা কোন ঘটনা একাধিকরূপে সত্য হইতে পারে না। একটি ঘটনা যখন দুই রকম বর্ণিত হয়, তখন হয়ত উহার কোন একটি সত্য অপরটি মিথ্যা অথবা উভয়ই সমরূপ মিথ্যা; উভয়ই যুগপৎ সত্য হইতে পারে না হয়ত সত্য অজ্ঞাতই থাকিয়া যায়। একব্যক্তি যাহাকে “সোনা” বলিল অপর ব্যক্তি তাহাকে বলিল “পিতল”। এ ক্ষেত্রে বস্তুটি কি দুই রূপেই সত্য হইবে? কেহ বলিল যে অমুক ঘটনা ১৫ই বৈশাখ ১২টায় ঘটিয়াছে; আবার কেহ বলিল যে, উহা ১৬ই চৈত্র ৩টায়। এস্থলে উভয় বক্তাই কি সত্যবাদী? এমতাবস্থায় উহাদের কোন ব্যক্তির কথায়ই শ্রোতার বিশ্বাস জন্মিতে পারে না। হয়ত কোন একজন ব্যক্তি উহাদের একজনের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিল, অনুরূপ অন্য একব্যক্তি অপরজনের কথা সত্য বলিয়া স্বীকার করিল, অপরজন তাহা মিথ্যা বলিয়া ভাবিল। এইরূপে উহার সত্যাসত্য নিরূপণে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঘটিল মতানৈক্য। আর এইরূপ মতানৈক্য হেতু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঘটিয়া থাকে নানারূপ ঝগড়া-কলহ, বিবাদ-বিসম্বাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এই রকম বিষয় বিশেষ ব্যক্তিগত মতানৈক্যর ন্যায় সমাজ বা রাষ্ট্রগত মতানৈক্যও আবহমানকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে; যাহার পরিণতি সাম্প্রদায়িক কলহ ও যুদ্ধবিগ্রহরূপে আজ আমরা চোখের উপরই দেখিতে পাইতেছি।
জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যে সব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলে না। আবার ধর্মজগতেও মতানৈক্যের অন্ত নাই যেখানে একইকালে দুইটি মত সত্য হইতে পারে না, সেখানে শতাধিক ধর্মে প্রচলিত শতাধিক মত সত্য হইবে কিরূপে? যদি বলা হয় যে, সত্য হইবে একটি; তখন প্রশ্ন হইবে কোনটি এবং কেন? অর্থাৎ সত্যতা বিচারের মাপকাঠি (Criterion for truth) কি? সত্যতা প্রমাণের উপায় (Test for truth) কি এবং সত্যের রূপ (Nature of truth) কি?
আমরা ঐ সকল দুরূহ দার্শনিক তত্ত্বের অনুন্ধানে প্রবিষ্ট হইব না, শুধু ধর্ম-জগতের মতানৈক্যের বিষয় সামান্য কিছু আলোচনা করিব।
আমাদের অভিজ্ঞতা হইতে আমরা জানিতে পাইতেছি যে, বিশ্বমানবের সহজাত বৃত্তি বা “স্বভাবধর্ম” একটি। এ সংসারে সকলেই চায়-সুখে বাঁচিয়া থাকিতে, আহার-বিহার ও বংশরক্ষা করিতে, সন্তান-সন্ততির ভিতর দিয়া অমর হইতে। মানুষের এই স্বভাবধর্মরূপ মহাব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সংসারে সৃষ্টি হইল কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, সমাজ, নীতি এবং রাষ্ট্র; গড়িয়া উঠিল জ্ঞান-বিজ্ঞানময় এই দুনিয়া। মানুষ যেখানে যে কাজেই লিপ্ত থাকুক না কেন, একটু চিন্তা করিলেই দেখা যাইবে যে, সে তার “স্বভাবধর্ম” বনাম “স্বধর্ম” পালনে ব্রতী। এই মহাব্রত উদযাপনে কাহারো কোন প্ররোচনা নাই এবং এই ধর্ম পালনে মানুষের মধ্যে কোন মতানৈক্য নাই।
এই স্বভাবধর্মই মানুষের ধর্মের সবটুকু নয়। এমন কি “ধর্ম” বলিতে প্রচলিত কথায় এই স্বভাবধর্মকে বুঝায় না। যদিও একথা স্বীকৃত হইয়া থাকে যে পশু, পাখী, কীট, পতঙ্গ এমন কি জলবায়ু, অগ্নি ইত্যাদিরও এক একটা ধর্ম আছে, তত্রাচ বিশ্বমানবের ধর্ম বা “মানব-ধর্ম” বলিয়া একটি আন্তর্জাতিক ধর্মকে স্বীকার করা হয় না। সাধারণত আমরা যাহাকে “ধর্ম” বলি তাহা হইল মানুষের কল্পিত ধর্ম। যুগে যুগে মহাজ্ঞানীগণ এই বিশ্ব সংসারের স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। স্রষ্টার প্রতি মানুষের কি কোন কর্তব্য নাই? নিশ্চয়ই আছে, “এইরূপ চিন্তা করিয়া তাঁহারা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিয়া দিলেন। অধিকন্তু মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও দেখাইয়া দিলেন সেই মহাজ্ঞানীগণ। এইরূপে হইল কল্পিত ধর্মের আবির্ভাব। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মনীষী বা ধর্মগুরুদের মতবাদ হল ভিন্ন ভিন্ন।
এই কল্পিত ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল উহাতে মতভেদ। ফলে পিতা-পুত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে এমন কি স্বামী-স্ত্রীতেও এই কল্পিত ধর্ম নিয়া মতভেদের কথা শোনা যায়। এই মতানৈক্য ঘুচাইবার জন্য প্রথমত আলাপ আলোচনা পরে পরে বাক-বিতণ্ডা, শেষ পর্যন্ত যে কত রক্তপাত হইয়া গিয়াছে, ইতিহাসই তার সাক্ষী। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বমানব একমত হইতে পারিয়াছে কি?
কেবল যে বিভিন্ন মত এমন নহে। একই ধর্মের ভিতরেও মতভেদের অন্ত নাই। হিন্দু ধর্মের বেদ যাহা বলে উপনিষদ সকল ক্ষেত্রে তাহার সহিত একমত নহে। আবার পুরাণের শিক্ষাও অনেক স্থলে অন্যরূপ। “বাইবেল” এর পুরাতন নিয়ম (Old Testament) ও নূতন নিয়মে (New Testament) অনেক পার্থক্য। পুনশ্চ প্রোটেষ্ট্যান্ট (Protestant) ও ক্যাথলিকদের (Roman Catholic) মধ্যেও অনেক মতানৈক্য রহিয়াছে।
পবিত্র কোরানপন্থীদের মধ্যেও মতবৈষম্য কম নহে। শিয়া, সুন্নী, মুতাজিলা, ওহাবী, কাদিয়ানী, খারীজী ইত্যাদি সাম্প্রদায়ের মত এক নহে। আবার একই সুন্নী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ¬ হানাফী, শাফী ইত্যাদি চারি মজাহাবের মতামত সম্পূর্ণ এক নহে। এমন কি একই হানাফী মজহাব অবলম্বী বিভিন্ন পীর ছাহেবদের যথা জৌনপুরী, ফুরফুরা, শর্ষিণা ইত্যাদি বিভিন্ন খান্দানের বিভিন্ন রেছালা। মহাত্না রাজা রামমোহন রায়ের অতি আধুনিক ব্রাহ্মধর্মও আধুনা দুই শাখায় বিভক্ত হইয়াছে।
এতোধিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ভক্তদের নিকট আপন আপন ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ, সনাতন ও ঈশ্বর অনুমোদিত, মুক্তি বা পরিত্রাণের একমাত্র পন্থা। বলা বাহুল্য যে, এরূপ ধারণা প্রত্যেক ধর্মেই বিদ্যমান। কোন ধর্মে একথা কখনও স্বীকার করে না যে, অপর কোন ধর্ম সত্য অথবা অমুক ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বর্গপ্র্রাপ্তি, মুক্তি বা নির্বাণ ঘটিবে। বরং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মযাজকেরা এই কথাই বলিয়া থাকেন যে, তাঁহাদের আপন আপন ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম অন্যকোন ধর্মই সত্য নহে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বর্গপ্রাপ্তি, পরিত্রাণ, নির্বাণ বা মোক্ষলাভ ঘটিবে না। এ যেন বাজারের গোয়ালাদের ন্যায় সকলেই আপন আপন দধি মিষ্টি বলে।
বর্তমান যুগে পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মই আস্তিক। বিশেষত একেশ্বরবাদী। হিন্দু ধর্মও মূলত একেশ্বরবাদী। তাই যদি হয়, অর্থাৎ জগতের সকল লোকই যদি একেশ্বরবাদী হয়, তবে তাহাদের মধ্যে একটি ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত। কিন্তু আছে কি? আছে যত রকম হিংসা, ঘৃণা, কলহ ও বিদ্বেষ। সম্প্রদায় বিশেষে ভুক্ত থাকিয়া মানুষ মানুষকে এত অধিক ঘৃণা করে যে, তদ্রূপ কোন ইতর প্রাণীতেও করে না। হিন্দুদের নিকট গোময় (গোবর) পবিত্র অথচ অহিন্দু মানুষ মাত্রেই অপবিত্র। পক্ষান্তরে মুসলমানদের নিকট কবুতরের বিষ্ঠাও পাক অথচ অমুসলমান মাত্রেই নাপাক। পুকুরে সাপ, ব্যাঙ মরিয়া পচিলেও উহার জল নষ্ট হয় না, কিন্তু বিধর্মী মানুষে ছঁুইলেও উহা হয় অপবিত্র। কেহ কেহ একথাও বলেন যে, অমুসলমানী পর্ব উপলক্ষে কলা, কচু, পাঠা বিক্রিও মহাপাপ। এমন কি মুসলমানের দোকান থাকিতে হিন্দুর দোকানে কোন কিছু ক্রয় করাও পাপ। এই কি মানুষের ধর্ম? না ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা?
মানবতার মাপকাঠিতে মানুষ একে অন্যের ভাই, ভালবাসার পাত্র, দয়ামায়ার যোগ্য, সুখ-দুঃখের ভাগী; এক কথায় একান্তই আপন। কিন্তু ধর্মে বানাইল পর।
স্বভাবত মানুষ সত্যকেই কামনা করে, মিথ্যাকে নয়। তাই আবহমানকাল হইতেই মানুষ “সত্যের সন্ধান” করিয়া আসিতেছে। দর্শন বিজ্ঞান, ভূগোল ইতিহাস, গণিত প্রভৃতি জ্ঞাননুশীলনের বিভিন্ন বিভাগ সর্বদাই চায় মিথ্যাকে পরিহার করিতে। তাই কোন দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক, কোন ঐতিহাসিক কিংবা নৈয়ায়িক সজ্ঞানে তাহাদের গ্রন্থে মিথ্যার সন্নিবেশ করেন না। বিশেষত তাঁহারা তাহাদের গ্রন্থের ভূমিকায় এমন প্রতিজ্ঞাও করেন না যে, তাহাদের গ্রন্থের কোথায়ও কোন ভুলভ্রান্তি নাই। অথবা থাকিলেও তাহা তাঁহারা সংশোধন করিবেন না। পক্ষান্তরে যদি কাহারো ভুলত্রুটি প্রমাণিত হয়, তবে তিনি তাহা অ্লানবদনে স্বীকার করেন এবং উহা সংশোধনের প্রয়াস পাইয়া থাকেন। এইরূপ পরবর্তী সমাজ পূর্ববর্তী সমাজের ভুলত্রুটি সংশোধন করিয়া নিয়া থাকে। এইরকম যুগে যুগে যখনই অতীত জ্ঞানের মধ্যে কোন ভুল ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় তখনই উহার সংশোধন হইয়া থাকে। এক যুগের বৈজ্ঞানিক সত্য আরেক যুগে মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া যায় এবং যখনই উহা প্রমাণিত হয়, তখনই বৈজ্ঞানিক সমাজ উহাকে জীর্ণবস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করেন ও প্রমাণিত নূতন সত্যকে সাদরে গ্রহণ করেন।
ধর্মজগতে কিন্তু ঐরূপ নিয়ম পরিলক্ষিত হয় না। তৌরীত, জরুর, ইঞ্জিল, ফোরকান, বেদ-পুরান, জেন্দ-আভেস্তা ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থসমূহের প্রত্যেকটি অপৌরুষেয় বা ঐশ্বরিক পুথি কি না, তাহা জানি না, কিন্তু ইহাদের প্রত্যেকটি গ্রন্থ এই কথাই বলিয়া থাকে যে, এই গ্রন্থই সত্য। যে বলিবে যে, ইহা মিথ্যা, সে নিজে মিথ্যাবাদী, অবিশ্বাসী, পাপী অর্থাৎ নরকী।
ধর্মশাস্ত্রসমূহের এইরূপ নির্দেশ হেতু কে যাইবে ধর্মাস্ত্রসমূহের বিরুদ্ধে কথা বলিয়া নরকী হইতে? আর বলিয়াই বা লাভ কি? অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থই গ্রন্থকারবিহীন অর্থাৎ ঐশ্বরিক বা অপৌরুষেয়, সুতরাং উহা সংশোধন করিবেন কে?
প্রাগৈতিহাসিককাল হইতে জগতে শত শত রাষ্ট্রের উত্থান হইয়াছে এবং পরস্পর কলহবিবাদের ফলে তাহাদের পতন ঘটিয়াছে। কিন্তু ধর্মে ধর্মে যতই কলহবিবাদ থাকুক না কেন জগতে যতগুলি ধর্মের আবির্ভাব ঘটিয়াছে তাহার একটিও আজ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয় নাই। ইহার প্রথম কারণ হইল এই যে, রাষ্ট্রের ন্যায় ধর্মসমূহের আয়ত্তে তোপ, কামান, ডিনামাইট বা এ্যাটম বোম নাই, যাহা দ্বারা একে অন্যের ধ্বংস সাধন করিতে পারে। ধর্মের হাতে আছে মাত্র দুইটি অস্ত্র – আশীর্বাদ ও অভিশাপ। এহেন অস্ত্রসমূহ ব্যক্তি বিশেষের উপর ক্রিয়াশীল কি না, জানি না, কিন্তু কোন সম্প্রদায় বা জাতির উপর একেবারেই অকেজো।
উহার দ্বিতীয় কারণ এই যে, প্রত্যেক ধর্মেই তাহার নির্দিষ্ট বিধি-বিধান সমূহের সত্যাসত্যের সমালোচনা একেবারেই বন্ধ। যেমন পাপ ও নরকের ভয়ে ভিতরের সমালোচনা বন্ধ, তেমন বাহিরের (ভিন্ন ধর্মের লোকদের) সমালোচনা চিরকালই বাতিল। কাজেই ধর্ম নির্বিঘ্নে আপন মনে দিন কাটাইতেছে। কিন্তু এইখানেই কি শেষ? না, বোবারও কল্পনা শক্তি আছে। মুখে কিছু বলিতে না পারিলেও সে বিশ্বের ঘটনাবলী সম্পর্কে চিন্তা করে, সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বোবার সেই ভাব সমূহের অভিব্যক্তি ঘটে তাহার কার্যাবলীর মধ্য দিয়া।
ধর্মজগতে মানুষের স্বাধীন চিন্তা-ক্ষেত্র নিতান্তই অপরিসর। তাই বাঁধ-ভাঙ্গা জলস্রোতের ন্যায় সময় সময় মানুষের কল্পনা ধর্মের বাঁধ ভাঙ্গিয়া বিধি-নিষেধের গণ্ডির বাহিরে চলিয়া যায়। ধর্মশাস্ত্র যে সকল বিষয় ভাবিতে নিষেধ করিয়াছে, মানুষ তাহাও ভাবে এবং সমস্যার সমাধান না পাওয়ায় দুই এক-জন আনাড়ী লোক ধর্ম যাজকদের নিকটে গোপনে প্রশ্ন করে ইহা কেন? উহা কেন? সমস্যা যতই জটিল হউক না কেন, উহার সমাধান হয়ত জলের মত সোজা। যাজক জবাব দেন, “ঐ সকল গুপ্ততত্ত্ব সমূহের ভেদ সে (আল্লাহ) ছাড়া কেহই জানে না। ধরিয়া লও ওসকল তারই মহিমা,” ইত্যাদি।
ইংরাজীতে একটি কথা আছে যে, জ্ঞানই পূণ্য (Knowledge is virtue)। কিন্তু যে বিষয়ে কোন জ্ঞান জন্মিল না, সে বিষয়ে পুণ্য কোথায়? কোন বিষয় বা ঘটনা না দেখিয়াও বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু একেবারেই না বুঝিয়া বিশ্বাস করে কিরূপে? যাজক যখন দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, না দেখিয়া এমন কি না বুঝিয়াই ঐ সকল বিশ্বাস করিতে হইবে, তখন মনে বিশ্বাস না জন্মিলেও পাপের ভয়ে অথবা জাতীয়তা রক্ষার জন্য মুখে বলা হয় “আচ্ছা”। বর্তমানকালের অধিকাংশ লোকেরই ধর্মে বিশ্বাস এই জাতীয়।
এই যে জ্ঞানের অগ্রগতির বাধা, মনের অদম্য স্পৃহায় আঘাত, আত্মার অতৃপ্তি, ইহাই প্রতিক্রিয়া মানুষের ধর্ম-কর্মে শৈথিল্য। এক কথায় মন যাহা চায়, ধর্মের কাছে তাহা পায় না। মানুষের মনের ক্ষুধা অতৃপ্তই থাকিয়া যায়। ক্ষুধার্ত বলদ যেমন রশি ছিঁড়িয়া অন্যের ক্ষেতের ফসলে উদর পূর্তি করে, মানুষের মনও তেমন ধর্ম-ক্ষেত্রের সীমা অতিক্রম করিয়া ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য ছুটিয়া যায় দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।
ধর্মের মূল ভিত্তি বিশ্বাস (ঈমান)। ধর্ম এই বিশ্বাসকেই আঁকড়াইয়া আছে। কিন্তু এই বিশ্বাস কি বা ইহা উৎপত্তির কারণ কি, ধর্ম তাহা অনুসন্ধান করে না। এই বিশ্বে যাহার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে, নিশ্চয়ই তাহার উপাদান বা কারণ আছে। বিশ্বাস জন্মিবার যে কারণ সমূহ বর্তমান আছে, পণ্ডিতেরা তাহা অনুসন্ধান করিয়া দেখাইয়াছেন। বিশ্বাস উৎপত্তির কারণাবলী সূক্ষ্মরূপে আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে, মনোবিজ্ঞানের যে কোন পুস্তুকে উহা পাওয়া যাইবে। আমরা শুধু মোটামুটিরূপে উহার কিঞ্চিৎ আভাস দিব।
জ্ঞানের সহিত বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক। বরং বলা হইয়া থাকে যে, জ্ঞান মাত্রেই বিশ্বাস। তবে যে কোন বিশ্বাস জ্ঞান নহে। প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর যে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত, তাহাকেই জ্ঞান বলা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইহাই খাঁটি বিশ্বাস। পক্ষান্তরে যে বিশ্বাস কল্পনা, অনুভূতি, ভাবানুসঙ্গ বা কামনার উপর প্রতিষ্ঠিত তাহা জ্ঞান নহে। তাহাকে অভিমত (Opinion) বলা হইয়া থাকে। চলতি কথায় ইহার নাম “অন্ধ-বিশ্বাস”। সচরাচর লোকে এই অন্ধ-বিশ্বাসকেই “বিশ্বাস” আখ্যা দিয়া থাকে। কিন্তু যাহা খাঁটি বিশ্বাস, তাহা সকল সময়ই বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা (Lesson Experience) প্রসূত, প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর প্রতিষ্টিত। যাহা প্রত্যক্ষ তাহা সর্বদাই বিশ্বাস্য। মানুষ যাহা কিছু প্রত্যক্ষ করে, তাহা তাহার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই করে এবং যাহা কিছু প্রত্যক্ষ করে, তাহাই বিশ্বাস করে। আমি স্বচক্ষে যাহা দেখিয়াছি, স্বকর্ণে যাহা শুনিয়াছি, স্ব-হস্তে যাহা স্পর্শ করিয়াছি তাহাতে আমার সন্দেহের অবকাশ কোথায়? যাহা আমাদের প্রত্যক্ষীভূত, তাহাতেই আমাদের অটল বিশ্বাস।
সংসারে এমন বস্তুও আছে, যাহাকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। অথচ সেই সকল বস্তুকে যে আমরা সন্দেহ করি এমনও নহে। অনেক অপ্রত্যক্ষীভূত জিনিস আছে, যাহা আমরা সন্দেহ করি এমনও নহে। অনেক অপ্রত্যক্ষীভূত জিনিস আছে, যাহা আমরা অনুমানের ভিত্তিতেই বিশ্বাস করি। এই যে মানুষের ‘প্রাণ শক্তি’, যার বলে মানুষ উঠা, বসা, চলাফেরা ইত্যাদি সংসারের নানাপ্রকার কাজকর্ম করিতেছে, তাহা কি আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি? করি নাই। কারণ ‘প্রাণ’ মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহে। প্রাণকে কোনরূপে প্রত্যক্ষ না করিলেও প্রাণের অস্তিত্বে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ প্রাণ যদিও ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে, তবুও ইহার কার্যকলাপ দৈহিক ঘটনারূপে আমরা প্রত্যক্ষ করিতেছি। “কার্য থাকিলে তাহার কারণ থাকিতে বাধ্য” এই স্বতঃসিদ্ধ যুক্তির বলে আমরা দৈহিক ঘটনাবলীর কারণরূপে প্রাণের অস্তিত্বকে অনুমান করিতেছি এবং বিশ্বাস করিতেছি যে প্রাণ আছে।
পূর্বেই বলিয়াছি যে, প্রত্যক্ষ ও অনুমান, এই দুইটির উপর খাঁটি বিশ্বাস বা জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত। যে বিশ্বাসের মূলে প্রত্যক্ষ বা অনুমান নাই অর্থাৎ যে বিশ্বাসের মূলে জ্ঞানের অভাব, তাহা খাঁটি বিশ্বাস নহে, অন্ধ-বিশ্বাস। বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে আমাদের সন্দেহ নাই। বিজ্ঞান যাহা বলে, তাহা আমরা অকুণ্ঠিত চিত্তে বিশ্বাস করি। কিন্তু অধিকাংশ ধর্ম এবং ধর্মের অধিকাংশ তথ্য অন্ধবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ ধর্মীয় বিধি-বিধান প্রত্যক্ষ বা আনুমানসিদ্ধ নহে। এজন্য ধর্মের অনেক কথায় বা ব্যাখ্যায় সন্দেহ থাকিয়া যায়। দ্বিধাহীন চিত্তে ধর্মীয় সকল অনুশাসনকে আমরা সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। তাই বিজ্ঞানের ন্যায় ধর্মের উপর সকল লোকের অটল বিশ্বাস হয় না। ধর্মকে সন্দেহাতীতরূপে পাইতে হইলে উহাকে অন্ধবিশ্বাসের উপর রাখিলে চলিবে না, উহাকে খাঁটি বিশ্বাস অর্থাৎ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।
আজকাল যেখানে-সেখানে শোনা যাইতেছে যে, সংসারে নানাপ্রকার জিনিস-পত্রাদি হইতে “বরকত” উঠিয়া গিয়াছে। কারণ লোকের আর পূর্বের মত ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস নাই। পূর্বে লোকের ঈমান ছিল, ফলে তাহারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করিত। আর আজকাল মানুষের ঈমান নাই, তাই তাহাদের অভাব ঘোচে না। ঈমান নাই বলিয়াই ক্ষেতে আর সাবেক ফসল জন্মে না, ফলের গাছে ফল ধরে না, পুকুরে-নদীতে মাছ পড়ে না। ঈমান নাই বলিয়াই মানুষের উপর খোদার গজবরূপে কলেরা, বসন্ত, বন্যা-বাদল, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি নানা প্রকার বালা-মুছিবত নাজেল হয়। অথচ মানুষের হুঁশ হয় না। এইরূপ যে নানা প্রকার অভাব-অভিযোগের জন্য ঈমানের অভাবকেই দায়ী করা হয়, তাহা কতটুকু সত্য?
শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেই জানেন আর যাহারা জানেন না তাহারা অনুসন্ধান করিলেই জানিতে পারিবেন যে, আমাদের এই সোনার বাংলার চাষীগণ বিঘা প্রতি বার্ষিক যে পরিমাণ ধান্য জন্মাইতেছে তাহারা প্রায় সাত-আট গুণ পরিমাণ ধান্য জাপানের চাষীরা জন্মাইতেছে। হয়ত অনুসন্ধান করিলে ইহাও জানা যাইতে পারে যে, জাপানের এই চাষীরা অ-মুসলমান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, কাফের, যাহাদের ধর্মে ঈশ্বরের নামগন্ধও নাই। আমাদের মতে উহারা বে ঈমান বা অ-বিশ্বাসী। তবুও উহারা বৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতি প্রয়োগে পূর্বের চেয়ে বেশী ফসল জন্মাইতেছে। আমাদের মতে উহারা বে-ঈমান হইলেও তাহাদের ক্ষেতের ফসল বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই।
কিছুদিন পূর্বে রাশিয়া-প্রত্যাগত বাংলাদেশের জনৈক নামজাদা ডাক্তার সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বলিয়াছিলেন যে, পূর্ব বাংলায় প্রতি বৎসর হাজার হাজার লোক কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারীর প্রকোপে প্রাণ হারায় এ কথা সেদেশের ডাক্তারেরা বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না। কারণ তাহারা একথা ভাবিতেও পারিতেছিলেন না যে, বর্তমান যুগেও কোন দেশে কলেরা বা বসন্তে ভুগিয়া অগণিত মানুষ প্রাণ হারায়। তবে কি একমাত্র বাংলার অধিবাসীদেরই ঈমান নাই? আর একমাত্র ইহাদের উপরই কি খোদার গজব বর্ষিত হয়? রাশিয়ানরা অধিকাংশই সাম্যবাদী (Socialist)। তাঁহারা দেব-দেবী বা আল্লা-নবীর ধার ধারে না। তবুও যাবতীয় কাজে তাঁহারা বৈজ্ঞানিক প্রণালী প্রয়োগ করিয়াই সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন-যাপন করিতেছেন।
যাহারা ঈমানের অভাবকে নানাবিধ অভাব-অনটনের জন্য দায়ী করেন, তাঁহারা একটু ভাবিলেই দেখিতে পাইতেন যে, ধনী ও গরীবের আয়-ব্যয়ের ধাপগুলি কোন কালেই এক নহে। গরীব চায় শুধু ভাত ও কাপড়। কিন্তু ধনী চায় তৎসঙ্গে বিলাস-ব্যসন। মানুষ সাধারণত অনুকরণপ্রিয়! তাই ধনীর বিলাসিতা বহুল পরিমাণে ঢুকিয়াছে গরীবের ঘরে। যাহার পিতার সম্পত্তি ছিল পাঁচ ঘিা জমি এবং পরিবারে ছিল তিনজন লোক, তাহার সংসারের নানা প্রকার খরচ নির্বাহ করিয়াও হয়ত কিছু উদ্বৃত্ত থাকিত। আজও সে ঐ জমির আয় দ্বারা তিনজন লোকই প্রতিপালন করে, কিন্তু উদ্বৃত্ত যাহা কিছু থাকিত, তাহা ব্যয় করিতেছে সাবান, সুবাসিত তৈল, সিল্কের চাদর, ছাতা ও জুতায়। বিলাস ব্যসনে যে অতিরিক্ত খরচ সে করিতেছে, তাহার হিসাব রাখে না, ভাবে ‘বরকত’ গেল কোথায়? এ কথা সে ভাবিয়া দেখে না যে, অমিতব্যয়িতা এবং বিলাসিতাই তাহার অভাব-অনটনের কারণ। অযথা ঈমানের অভাবকে কারণ বলিয়া দায়ী করে।
প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে যেখানে (অখণ্ড ভারতে) জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৯ কোটি, বৃদ্ধি পাইয়া আজ সেখানে জনসংখ্যা দাঁড়াইয়াছে প্রায় ৬৯ কোটি। এই যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ৩৯ কোটি মানুষ ইহারা খায় কি? লোক বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য বৃদ্ধি না হইলে খাদ্যখাদকের সমতা থাকিবে কিরূপে? লোক বৃদ্ধি যতই হোক জমি বৃদ্ধির উপায় নাই। কাজেই অনাবাদী জমি আবাদ, উপযুক্ত সার প্রয়োগ, উৎকৃষ্ট বীজ ব্যবহার ও বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে চাষাবাদ ছাড়া বর্তমানে খাদ্য বৃদ্ধির উপায় নাই। অথচ আমাদের দেশে কয়জন চাষী এবিষয়ে সচেতন? আজও সরকারী বীজ ভাণ্ডারে ভাল বীজ বিকায় না। এমোনিয়া সালফেট ও বোনমিল বস্তা ছিঁড়িয়া পড়িয়া থাকে গুদামের মেঝেয়, রেড়ির খৈল পচিয়া থাকে গুদামে। পল্লী অঞ্চলে ইতস্তত ঝোপ-জঙ্গলের অভাব নাই, বসত বাড়ীর আনাচে-কানাচে জন্মিয়া থাকে ভাইট গাছ আর গুড়ি কচু। বেড় পুকুরে কচুরী পানা ঠাসা। বৃদ্ধি পাইয়াছে শুধু মশা, মাছি ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত আর ডাক্তার খরচ। এইত আমাদের অশিক্ষিত দেশের অবস্থা। বর্তমানের খাদ্যের অভাব ঘটিয়াছে তাহা সত্য। কিন্তু ইহা খাদ্যখাদকের সমতার অভাবেই ঘটিয়াছে, “বে-ঈমান” বা অবিশ্বাসের জন্য নয়।
ম্যালথুস (Malthus) তাঁর “পপুলেশন” নামক গ্রন্থে বলিয়াছেন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি অনুপাত আছে, যে অনুপাত জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। তবে দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসাধারণের আহার-বিহার এবং রীতি-নীতি তারতম্যে সামান্য ব্যতিক্রম ঘটিতে পারে।
আমাদের দেশের জন্ম-হার অত্যধিক, জনসংখ্যা অস্বাভাবিক রূপে বৃদ্ধি পাইতেছে শিশু, বিধবা ও বহুবিবাহে। যে ছেলের ২০ বৎসর বয়সে বিবাহ হওয়া উচিত, সে ছেলের ঐ বয়সে ছেলে-মেয়ে জন্মে দুই তিনটি। আবার তিন বৎসর বয়সে যে মেয়ের বিবাহ হয়, বারো-তেরো বৎসর বয়সে সে হয় মেয়ের মা। কথায় বলে “কচি ফলের বীজ ভাল না।” অপ্রাপ্ত বয়স্ক পিতা-মাতার সন্তান উৎপাদনে পিতা-মাতা ও শিশু উভয়ই হয় স্বাস্থ্যহীন। পিতার বয়স ত্রিশ হইলে চুল পাকে, পঁয়ত্রিশে দাঁত নড়ে, চল্লিশে হয় কঁুজো, হাঁপানি ও প্রবাহিকায় পঞ্চাশেই ভবলীলা সঙ্গে করে। এমতাবস্থায় বিধবা স্ত্রীর উপায় কি? কোন ছেলের ব্যথার ব্যারাম, কোন ছেলের জীর্ণজ্বর, ছোট মেয়েটি কোলে লয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা। এইরূপ স্বাস্থ্যহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া দেশের অভাব দৈনন্দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। আর ইহার সাথে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অলসতা ও কুসংস্কার প্রভৃতি ত আছেই। সুখের বিষয় এই যে, সরকারী নির্দেশে শিশু বিবাহটা বর্তমানে কমিয়াছে।
বহুবিবাহের প্রতিক্রিয়াও সমাজ জীবনে কম নহে। ইহা শুধু বংশবিস্তার করিয়াই ক্ষান্ত থাকে না। ইহার ফলে নানাপ্রকার পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। বৈমাত্রেয় সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধির ফলে উহাদের মধ্যে ফরায়েজের অংশ লইয়া মানোমালিন্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা অবশেষে মামলা-মোকর্দ্দমা ও উকিল-মোক্তার, আমলা-পেস্কার ইত্যাদির হয় আয় বৃদ্ধি।
জন্ম বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুতেও নিস্তার নাই, ইহাতেও খরচ আছে। প্রথমত জানাজা, কাফন ইত্যাদি খরচ ত আছেই তদুপরি মোর্দাকে গোর-আজাব হইতে রক্ষা করিতে, পোলছিরাত পার করিতে, বেহেস্ত সহজলভ্য করিতে প্রতি বৎসর রমজান মাসে মৌলুদ শরীফ, কোরান শরীফ খতম ইত্যাদি না-ই হোক, অন্ততপক্ষে কয়েকজন মোল্লা-মৌলবী ডাকিয়া তশবিহ্ পড়াইয়া কিছুটা ডা’ল-চা’ল খরচ না করিলেই চলে না। মানুষের অভাব বৃদ্ধির কারণাবলীর প্রতি চক্ষু মুদিয়া থাকিয়া উগ্রবিশ্বাসীরা ঈমানের অভাবকেই অভাব-অনটনের কারণ বলিয়া সাব্যস্ত করিতেছে।
“এখন আর মানুষের মনে পূর্বের ন্যায় ঈমান নাই”, এ কথা বলিয়া যাঁহারা রোদন, করেন, তাঁহারা একটু ভাবিয়া দেখিতে পারেন যে, বিশ্বাস গেল কোথায়? বিজ্ঞান মতে পদার্থের ধ্বংস নাই, আছে শুধু পরিবর্তন। দেখা যায় তদ্রূপ মানব মনের বিশ্বাসেরও লয় নাই, আছে শুধু পরিবর্তন। পূর্বে লোকে নানা প্রকার উপকথা, রূপকথায়ও বিশ্বাস করিত। কিন্তু এখন আর তাহা করে না। নানা প্রকার ভূতের গল্প, জ্বীন-পরীর কাহিনী, নানা প্রকার তন্ত্র-মন্ত্র অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেই আজকাল আর বিশ্বাস করেন না। তবে যে উহা সমাজে একেবারেই অচল, তাহা নহে। “রূপকথা” লোকে রূপকথা বলিয়াই গ্রহণ করিতেছে, “সত্য” বলিয়া মনে করিতেছেন না। এক সময় উপন্যাসকে লোকে ইতিহাস মনে করিত। কিন্তু এখন আর তাহা করে না, ম্যাজিকের আশ্চর্য খেলাগুলি সকলেই আগ্রহের সহিত দেখে, কিন্তু তাহা সত্য বলিয়া কেহ বিশ্বাস করে না। তাই বলিয়া ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিশ্বাস মুছিয়া যায় নাই। যেমন কতক বিষয় হইতে বিশ্বাস উঠিয়া গিয়াছে, তেমন কতক বিষয়ে বিশ্বাস মুছিয়া যায় নাই। যেমন কতক বিষয় হইতে বিশ্বাস উঠিয়া গিয়াছে, তেমন কতক বিষয়ে বিশ্বাস জন্মাইয়াছে, বিশ্বাসযোগ্য “বস্তু” বা “বিষয়” এর পরিবর্তন হইয়াছে মাত্র।
বলা হয় যে, আল্লাহ তা’লার অসাধ্য কোন কাজ নাই। বিশেষ বিশ্বাসী ভক্তদের অনুরোধে তিনি অসম্ভবকেও সম্ভব করেন। হযরত সোলায়মান নবী নাকি সিংহাসনে বসিয়া সপরিষদ শূন্যে ভ্রমণ করিতেন। তাই বলিয়া “আল্লাহ তা’লা ইচ্ছা করিলে জায়নামাজ শুদ্ধ আমাকেও নিমিষের মধ্যে মক্কায় পৌঁছাইতে পারেন” এইরূপ বিশ্বাস কোন কোন পীর ছাহেবের আছে কি? থাকিলে একবারও তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন কি? না দেখিয়াই বা উড়ো জাহাজে চড়িবার কারণ কি? উড়োজাহাজে চড়িবার বিপদ আছে, ভাড়া আছে আর সময়ও লাগে যথেষ্ট। তবুও উহার উপর জন্মিয়াছে বিশ্বাস।
অতীতে কোন কোন বোজর্গান হাটিয়াই নদী পার হইতে পারিতেন। যেহেতু তাঁহাদের বিশ্বাস ছিল যে, নদী পার করাইবেন আল্লাহতা’লা, নৌকা বা জলাযানের প্রয়োজন নাই। আর বর্তমানে খোদার উপর বিশ্বাস নাই, নদী পার হইতে সাহায্য লইতে হয় নৌকার।
সুফীগণ নাকি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পৃথিবীর কোথায় কি ঘটিতেছে, তাহা জানিতে ও দেখিতে পাইতেন। এখন কয়টি লোকে উহা বিশ্বাস করে? বর্তমানে বিশ্বাস জন্মিয়াছে টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও এবং টেলিভিশনে।
শাহছাহেবদের “কালাম”-এর তাবিজে কৃমি পড়ে না, কৃমি পড়ে স্যান্টোনাইন কুইনাইন সেবনে। মানত সিন্নিতে জ্বর ফেরে না, জ্বর ফেরাইতে সেবন করিতে হয় কুইনাইন। লোকে বিশ্বাস করিবে কোনটি? নানাবিধ রোগারোগ্যের জন্য পীরের দরগাহ হইতে হাসপাতালকেই লোকে বিশ্বাস করে বেশী। গর্ভিনীর সন্তান প্রসব যখন অস্বাভাবিক হইয়া পড়ে, তখন পানি পড়ার চেয়ে লোকে বেবী ক্লিনিকের (Baby Clinic) উপর ভরসা রাখে বেশী।
আজ মহাসমুদ্রের বুকে লোক যাতায়াত করে কোন বিশ্বাসে? সমুদ্রের গভীর জলের নীচে লোকে সাবমেরিন চালায় কোন বিশ্বাসে? মহাকাশ পাড়ি দেয় লোকে কোন বিশ্বাসে? যন্ত্রে বিশ্বাস আছে বলিয়াই মানুষ যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করিতেছে। দ্রব্যগুণে বিশ্বাস আছে বলিয়াই লোকে কলেরা-বসন্তের সময় দোয়া-কালামের পরিবর্তে ইনজেকশন ও টীকা লইতেছে।
পূর্বেই বলিয়াছি যে, বিশ্বাস ধরাপৃষ্ঠ হইতে অবলুপ্ত হয় নাই, শুধু বিশ্বাসযোগ্য বিষয় বস্তুর পরিবর্তন হইয়াছে মাত্র। চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রেই বুঝিতে পারিবেন যে, যেখানে যে বিষয়ে মানুষের জ্ঞান জন্মিতেছে সেইখানেই বিশ্বাস (ঈমান) দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর হইতেছে আর যেখানে যে বিষয়েতে জ্ঞান জন্মে নাই, জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয় হইতে ক্রমশ বিশ্বাস লোপ পাইতেছে। অর্থাৎ সন্দেহ জাগিতেছে। যে কথায় বা যে বিষয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন প্রমাণ নাই, যে বিষয় কার্য কারণ সম্পর্ক নাই বা যাহা বিবেক বিরোধী, বর্তমানে শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রেই সে সকল ব্যাপারে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারেন না।
ধর্মজগতে এমন কতগুলি বিধি-নিষেধ, আচার-অনুষ্ঠান ও ঘটনাবলীর বিবরণ পাওয়া যায়, যাহার যুক্তিযুক্ত কোন ব্যাখ্যা সাধারণের বোধগম্য নহে। তাই সততই মনে কতগুলি প্রশ্ন উদয় হয় এবং সেই প্রশ্নগুলির সমাধানের অভাবে ধর্মের বিধি-বিধানের উপর লোকের সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্মে। ফলে ধর্মের বিধি-বিধানের উপর লোকের শৈথিল্য ঘটে। ধর্মযাজকদের অধিকাংশের নিকটই সেই সকল প্রশ্নাবলীর সদুত্তর পাওয়া যায় না। অনেক সময় উত্তর দেওয়া দূরে থাক শুধু প্রশ্ন করার জন্য উল্টা কাফেরী ফতুয়া দিতেও তাহাদের দেরী হয় না। অথচ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি তাহাদের মতানুযায়ী পালন না করিলে তাহার উপর তাহারা সাধ্যমত দল বাঁধিয়া অত্যাচার করিতেও ইতস্তত করে না। ধর্মের নাম করিয়া ধর্ম বিরোধী কাজ করিতেও উহাদের বাধে না। পবিত্র কোরান যে বলিতেছে “লা ইক্রাহা ফিদ্দীন,” অর্থাৎ ধর্মে জবরদস্তি নাই, সেদিকে উহারা ভ্রূক্ষেপ করে না। অধিকন্ত সরকারী আইন বাঁচাইয়া যতদূর ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়, তাহা করিতেও ত্রুটি করে না। উপরন্ত রাজশক্তিকে হস্তগত করিয়া ধর্মের নামে অধর্মকে চালাইবার আকাশ-কুসুমও উহারা রচনা করিতেছে।
ধর্মরাজ্য সম্বন্ধে চিন্তা করিলে সাধারণত মনে যে সকল প্রশ্নের উদয় হয়, আমরা এখন তাহার কতগুলি প্রশ্ন বিবৃত করিব এবং প্রশ্নগুলি কেন হইতেছে, তার হেতু স্বরূপ যথাযোগ্য বাখ্যা প্রশ্নের সহিত সন্নিবেশিত করিব।
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1795#sthash.QbDefoce.dpuf
০২.প্রথম প্রস্তাব
[আত্মা বিষয়ক] ঃ
১। আমি কে?
মানুষের আমিত্ববোধ যত আদিম ও প্রবল তত আর কিছুই নহে। আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি দেখিতেছি, আমি শুনিতেছি, আমি বাঁচিয়া আছি, আমি মরিব ইত্যাদি হাজার হাজার রূপে আমি আমাকে উপলব্ধি করিতেছি। কিন্তু যথার্থ “আমি” — এই রক্ত-মাংস, অস্থি, মেদ-মজ্জা-গঠিত দেহটাই কি “আমি”? তাই যদি হয়, তবে মৃত্যুর পরে যখন দেহের উপাদান সমূহ পচিয়া-গলিয়া অর্থাৎ রাসায়নিক পরিবর্তনে কতগুলি মৌলিক ও যৌগিক পদার্থে রূপান্তরিত হইবে, তখন কি আমার আমিত্ব থাকিবে না? যদি না-ই থাকে, তবে স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কে? নতুবা “আমি” কি আত্মা? যদি তাহাই হয়, হবে আত্মাকে “আমি” না বলিয়া “আমার”, ইহা বলা হয় কেন? যখন কেহ দাবী করে যে, দেহ আমার, প্রাণ আমার এবং মন আমার, তখন দাবীদারটা কে?
২। প্রাণ কি অরূপ না সরূপ?
প্রাণ যদি অরূপ বা নিরাকার হয়, তবে দেহাবসানের পরে বিশ্বজীবের প্রাণসমূহ একত্র হইয়া একটি অখণ্ড সত্তা বা শক্তিতে পরিণত হইবে না কি? অবয়ব আছে বলিয়াই পদার্থের সংখ্যা আছে, নিরবয়ব বা নিরাকারের সংখ্যা আছে কি? আর সংখ্যা না থাকিলে তাহার স্বাতন্ত্র্য থাকে কি? পক্ষান্তরে প্রাণ যদি সরূপ বা সাকার হয়, তবে তাহার রূপ কি?
৩। মন ও প্রাণ কি এক?
সাধারণত আমরা জানি যে, মন ও প্রাণ এক নহে। কেননা উহাদের চরিত্রগত পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা আমাদের নিজেদের উপলব্ধি হইতে জানিতে পাইতেছি যে, “মন” প্রাণের উপর নির্ভরশীল কিন্তু “প্রাণ” মনের উপর নির্ভরশীল নয়। মন নিষ্ক্রিয় থাকিলেও প্রাণের অভাব পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু প্রাণ নিষ্ক্রিয় হইলে মনের অস্তিত্বই থাকে না। যেমন ক্লোরোফরম প্রয়োগে মানুষের সংজ্ঞা লোপ ঘটে, অথচ দেহে প্রাণ থাকে, শ্বাসক্রিয়া, হৃৎক্রিয়া এমন কি পরিপাক ক্রিয়াও চলিতে থাকে। অথচ তখন আর মনের কোন ক্রিয়াই প্রকাশ পায় না। গভীর সুনিদ্রাকালেও কোন সংজ্ঞা থাকে না, ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, প্রাণবিহীন মন থাকিতেই পারে না, কিন্তু মন বা সংজ্ঞাহীন প্রাণ অনেক সময়ই পাওয়া যায়। ইহাতে অনুমতি হয় যে, মন আর প্রাণ এক নহে। ইহাও অনুমতি হয় যে, সংজ্ঞা চেতনা বা সুখ-দুঃখের অনুভূতি মনেরই, প্রাণের নয়। প্রাণ রাগ, শোক, ভোগ ও বিলাসমুক্ত। এক কথায় প্রাণ চির নির্বিকার।
জীবের জীবন নাকি যমদূত (আজরাইল) হরণ করেন। কিন্তু তিনি কি প্রাণের সহিত মনকেও হরণ করেন? অথবা প্রাণ যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, মনকে তৎসঙ্গে থাকিতেই হইবে, এরূপ কোন প্রমাণ আছে কি? নতুবা মনবিহীন প্রাণ পরকালের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কিরূপে?
৪। প্রাণের সহিত দেহ ও মনের সম্পর্ক কি?
দেহ জড় পদার্থ। কোন জীবের দেহ বিশ্লেষণ করিলে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, লৌহ, ফসফরাস ইত্যাদি নানা প্রকার মৌলিক পদার্থের বিভিন্ন অনুপাতে অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। পদার্থসমূহ নিষ্প্রাণ। কাজেই পদার্থসমূহের যথানুপাতে সংমিশ্রিত অবস্থাকেই প্রাণ বলা যায় না। পদার্থ সমূহের যথানুপাতে সংমিশ্রণ এবং আরও কিছুর ফলে দেহে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। ঐ “আরও কিছু” কে আমরা মন বলিয়া থাকি। কিন্তু মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে কিছু সম্পর্ক বা বন্ধন আছে কি? থাকিলে তাহা কিরূপ? আর না থাকিলেই বা উহারা একত্র থাকে কেন?
৫। প্রাণ চেনা যায় কি?
কোন মানুষকে “মানুষ” বলিয়া অথবা কোন বিশেষ ব্যক্তিকে আমরা তাহার রূপ বা চেহারা দেখিয়াই চিনিতে পাই, প্রাণ দেখিয়া নয়। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সকলকে রূপ দেখিয়াই চিনি, সম্বোধন করি, তাহাদের সাথে প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম নিষ্পন্ন করি। প্রাণ দেখিয়া কাহাকেও চিনিবার উপায় নাই। তদ্রূপ পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা ইত্যাদিকে আমরা উহাদের রূপ দেখিয়াই চিনিয়া থাকি। এই রূপ বা চেহারা দেহীর দেহেই প্রকাশ পাইয়া থাকে। যখন দেহের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্কে থাকিবে না অর্থাৎ মৃত্যুর পরে দেহহীন প্রাণকে চিনিবার উপায় কি? বিভিন্ন ব্যক্তি বা জীবের মন, জ্ঞান ও দৈহিক গঠনে যতই বৈচিত্র্য থাকুক না কেন, উহাদের প্রাণেও কি তেমন বৈচিত্র্য আছে? অর্থাৎ বিভিন্ন জীবের প্রাণ কি বিভিন্ন রূপ?
৬। আমি কি স্বাধীন?
“আমি” মনুষ্যদেহধারী মন-প্রাণবিশিষ্ট একটি সত্তা। প্রাণশক্তি বলে আমি বাঁচিয়া আছি, মনে নানাপ্রকার কার্য করিবার স্পৃহা জাগিতেছে এবং দেহের সাহায্যে উক্ত কার্যাবলী নিষ্পন্ন করিতেছি। আমি যে শারীরিক ও মানসিক শক্তির অধিকারী, তাহা আমার কার্যাবলীর মধ্যেই প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন এই যে, আমি স্বাধীন কি না। যদি আমি স্বাধীন হই অর্থাৎ আমার কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ঈশ্বরের না থাকে, তাহা হইলে তাঁহার “সর্বশক্তিমান” নামের সার্থকতা থাকে কি? আর যদি আমি স্বাধীন না-ই হই, তবে আমার কার্যাবলীর ফলাফল স্বরূপ পাপ বা পুণ্যের জন্য আমি দায়ী হইব কিরূপে?
৭। অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকিবে?
মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কোন একটির অভাব থাকিলে, ঐ ইন্দ্রিয়টির মাধ্যমে যে জ্ঞান হইতে পারিত, তাহা আর হয় না। যে অন্ধ বা বধির, সে আলো বা শব্দে জ্ঞান পাইতে পারে না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অভাবে জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুতে মানুষের দেহ নষ্ট হয় এবং তৎসঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলিও নষ্ট হয়। এখন প্রশ্ন এই যে, মৃত্যুর পরে শরীর ও ইন্দ্রিয়বিহীন আত্মার জ্ঞান থাকিবে কি? থাকিলে তাহা কিরূপে থাকিবে?
৮। প্রাণ কিভাবে দেহে আসা-যাওয়া করে?
কেহ কেহ বলেন যে যাবতীয় জীবের বিশেষত মানুষের প্রাণ একই সময় সৃষ্টি হইয়া “ইল্লিন” নামক স্থানে রক্ষিত আছে। তথা হইতে রমণীদের গর্ভের তৃতীয় কি চতুর্থ মাসে প্রাণ ভ্রূণে আবির্ভূত হয়। গর্ভস্থ শিশুর দেহে আল্লাহ তা’লার হুকুমে প্রাণ নিজেই আসে, না কোন ফেরেস্তা প্রাণকে শিশুর দেহে ভরিয়া দিয়া যায়, তাহা জানি না; কিন্তু ধর্মাধ্যায়ীগণ ইহা নিশ্চিত করিয়াই বলেন যে, একটি জীবের দেহে একটি প্রাণই আমদানী হয়। ইহা কেহ কখনও বলেন না যে, একটি জীবের একাধিক প্রাণ থাকিতে পারে বা আছে। “পঞ্চপ্রাণ” বলিয়া যে একটি বাক্য আছে, যথা, প্রাণ, আপ্রাণ, সমান, উদান ও ধ্যান, উহা হইল শরীরস্থ বায়ুর পাঁচটি অবস্থা মাত্র। প্রাণশক্তি একই।
সচরাচর এক গর্ভে মানুষ জন্মে একটি। কিন্তু বিড়াল, কুকুর, ছাগল ও শৃগালাদি প্রায়ই একাধিক জন্মিয়া থাকে। মানুষেরও যমজ সন্তান হওয়া চলতি ঘটনা, ক্বচিৎ চারি-পাঁচ বা ততোধিক সন্তান জন্মিবার কথাও শোনা যায়। ঐ সকল ক্ষেত্রে কি প্রতি গর্ভে একাধিক প্রাণ আমদানী হয়, না একটি প্রাণই বিভক্ত হইয়া বহুর সৃষ্টি হয়।
কেঁচো ও শামুকাদি ভিন্ন যাবতীয় উন্নত জীবেরই নারী-পুরুষ ভেদ আছে, কচিৎ নুপংসকও দেখা যায়। কিন্তু জীব জগতে নারী ও পুরুষ, এই দুই জাতিই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। প্রতিটি জীব বা মানুষ জন্মিবার পূর্বেই যদি তার স্বতন্ত্র সত্ত্বাবিশিষ্ট প্রাণ সৃষ্টি হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই প্রাণেরও লিঙ্গভেদ আছে কি? যদি থাকেই তাহা হইলে অশরীরী নিরাকার প্রাণের নারী, পুরুষ এবং ক্লীবের চিহ্ন কি? আর যদি প্রাণের কোন লিঙ্গভেদ না থাকে, তাহা হইলে এক জাতীয় প্রাণ হইতে ত্রিজাতীয় প্রাণী জন্মে কিরূপে? লিঙ্গভেদ কি শুধু জীবের দৈহিক রূপায়ণ মাত্র? তাহাই যদি হয়, তবে পরলোকে মাতা-পিতা, ভাই-ভগিনী ইত্যাদি নারী-পুরুষ ভেদ থাকিবে কিরূপে? পরলোকেও কি লিঙ্গজ দেহ থাকিবে? প্রকৃতির নিয়মানুসারে কোন জীবের দেহে প্রাণ না থাকিলে সে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। বরং নির্জীবদেহ জৈবধর্ম হারাইয়া জড় পদার্থের ধর্ম পায় এবং তাহা নানারূপ রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে রূপান্তর গ্রহণ করে। অর্থাৎ পচিয়া গলিয়া নষ্ট হইয়া যায়। মাতৃগর্ভস্থ মানবশিশু যদি তিন-চারি মাস বয়সের সময়ে প্রাণ প্রাপ্ত হয়, তবে সে মাতা-পিতার মিলন মুহূর্তের পর হইতে নিষ্প্রাণ (ভ্রূণ) অবস্থায় বৃদ্ধি পায় কেন এবং পচিয়া গলিয়া নষ্ট হইয়া যায় না কেন? প্রাণের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, কোন কোন বৃক্ষের একটি হইতে দশটি শাখা কাটিয়া রোপণ করিলে তাহা হইতে পৃথক পৃথক দশটি জীবিত বৃক্ষের উৎপত্তি হয়। এই রোপিত দশটি বৃক্ষের যে দশটি স্বতন্ত্র জীবন, ইহা কোথা হইতে, কোন সময় কিভাবে আসে? স্বর্গ হইতে কোন দূতের মারফতে, না পূর্ব বৃক্ষ হইতে? সদ্য বধ করা গরু, মহিষ বা ছাগলাদির কাটা মাংস যাহারা স্বহস্তে নাড়া-চড়া করিয়াছেন, তাহারা কেহ কেহ হয়ত লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন, কতগুলি খণ্ডিত মাংস আঘাতে সাড়া দেয়। যে জন্তুটিকে বধ করিবার পর তার দেহ শত শত খণ্ডে খণ্ডিত করা হয়, তার সেই মাংস খণ্ডগুলি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকিয়া আঘাতে সাড়া দেয় বা স্পন্দিত হয় কেন? কোন রকম আঘাতে সাড়া দেওয়াটা জীবন বা জীবিতের লক্ষণ, কিন্তু মৃত প্রাণীর মাংসখণ্ডে জীবন কোথা হইতে আসে? কোন জীবের জীবন যমদূত হরণ করিয়া লওয়ার পরেও কি প্রাণের কিছু অংশ জীবদেহে থাকিতে পারে? আর থাকিলেও কি একটি প্রাণের শত শত খণ্ডে খণ্ডিত হওয়া সম্ভব?
জীবতত্ত্ববিদ পণ্ডিতগণ বলেন যে, প্রাণীদেহ কতগুলি জীবকোষ (Cell)-এর সমবায়ে গঠিত। জীবকোষগুলি প্রক্যেকে জীবন্ত। অর্থাৎ প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে জীবিত। সাপ, কেঁচো, টিকটিকি ইত্যাদির লেজ কাটিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলে, তাহা দেহ হইতে দূরে পড়িয়াও লাফাইতে থাকে। এক্ষেত্রে জন্তুটির একটি প্রাণ দুইস্থানে থাকিয়া নড়াচড়া করিতেছে না। লেজস্থিত জীব কোষগুলি স্বতন্ত্র জীবনের কিছু সময় বাঁচিয়া থাকিতে পারে, তেমন স্বতন্ত্রভাবে মরিতেও পারে। মানুষের খোস, পাঁচড়া, দাদ ইত্যাদি এবং কতিপয় ক্ষত রোগ আরোগ্য হইলে রুগ্নস্থান হইতে যে মরামাস (মৃত চর্মের ফুসকুরী) উঠিয়া থাকে, উহাই জীবকোষের স্বতন্ত্র মৃত্যুর নিদর্শন। ইহা ভিন্ন যে কোন জীবিত বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার মৃত্যুতেও জীবকোষের স্বতন্ত্র মৃত্যু সূচিত করে।
একটি জীবকোষ বিভাজন প্রাণালীতে দুইটিতে, দুইটি হইতে চারিটি এবং তাহা হইতে আটটিতে পরিণত হয়। এই রূপ ক্রমান্বয়ে সংখ্যায় বৃদ্ধি হইয়া একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণী সৃষ্টি হয়। মানুষের বেলায়ও একটি মাত্র ডিম্ব কোষ (Egg cell) আর একটি জনন কোষ (Germ cell) একত্র মিলিত হইয়া বিভাজন প্রণালীতে সংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া একটি পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দেহে বহু কোটি জীবকোষের সমষ্টি হইয়া দাঁড়ায়। একটি মানুষের প্রাণ বহু কোটি প্রাণের সমবায়ী শক্তি। আমরা উহার নাম দিতে পারি “মহাপ্রাণ”। কাজেই একটি জন্তুর দেহে প্রাণ “বহু”, কিন্তু “মহাপ্রাণ” একটি। জীব দেহের যাবতীয় জীব কোষের এককালীন মৃত্যুকে অর্থাৎ মহাপ্রাণের তিরোধানকে আমরা জীবের “মৃত্যু” বলি এবং জীব দেহের কোন অংশের জীব কোষের মৃত্যুকে বলি “রোগ”।
উপরোক্ত ধর্মীয় ও জীবতত্ত্বীয় মতবাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনটি?
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1796#sthash.dNpAL91p.dpuf
০৩. দ্বিতীয় প্রস্তাবঃ-
[ঈশ্বর বিষয়ক]ঃ
১। আল্লাহর রূপ কি?
জগতের প্রায় সকল ধর্মই এ কথা স্বীকার করে যে, ঈশ্বর অদ্বিতীয় নিরাকার ও সর্বব্যাপী। কথা কয়টি অতীব সহজ ও সরল। কিন্তু যখন হিন্দুদের মুখে শোনা যায় যে, সৃষ্টি পালনের উদ্দেশ্যে ভগবান মাঝে মাঝে সাকারও হইয়া থাকেন ও যুগে যুগে “অবতার” রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া লীলা প্রকাশ করেন এবং যখন খৃষ্টানদের নিকট শোনা যায় যে, পরম সত্তা “ভগবান, মশীহ্, পরমাত্মা” — এই ত্রিত্বে প্রকাশ পাইতেছে; আবার যখন মুসলিম ধর্মযাজকদের নিকট শোনা যায় যে, আল্লাহতা’লা আরশে “কুরছির” উপর বসিয়া রেজওয়ান নামক ফেরেস্তার সাহায্যে বেহেস্ত, মালেক নামক ফেরেস্তার সাহায্যে দোজখ, জেব্রাইলের সাহায্যে সংবাদ এবং মেকাইলকে দিয়া খাদ্য বণ্টন ও আবহাওয়া পরিচালনা করেন — তখনই মন ধাধাঁয় পড়ে, বৃদ্ধি বিগড়াইয়া যায়। মনে প্রশ্ন জাগিতে থাকে — নিরাকার সর্বশক্তিমান ভগবানের সৃষ্টি পালনে সাকার হইতে হইবে কেন? অদ্বিতীয় ঈশ্বরের মহত্ত্ব প্রকাশে ত্রিত্বের আবশ্যক কি? সর্বব্যাপী আল্লাহ্তা’লার স্থায়ী আসনে অবস্থান কিরূপ এবং বিশ্বজগতের কার্য পরিচালনার জন্য ফেরেস্তার সাহায্যের আবশ্যক কি?
২। খোদাতাআ’লা কি মনুষ্য ভাবাপন্ন?
আল্লাহ্তা’লা দেখেন, শোনেন, বলেন ইত্যাদি শুনিয়া সাধারণ মানুষের মনে স্বতঃই প্রশ্ন জাগে — তবে কি আল্লাহ্র চোখ, কান ও মুখ আছে? কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে আছে। তবে তাহা মানুষের মত নয়, কুদরতি। কিন্তু “কুদরতি” বলিতে কিরূপ বুঝায়, তাহা তাঁহারা ব্যাখ্যা করেন না। আবার যখন শোনা যায় যে, খোদাতা’লা অন্যায় দেখিলে ক্রুদ্ধ হন, পাপীদের ঘৃণা করেন, কোন কোন কাজে খুশী হ’ন ও কোন কোন কাজে হ’ন বেজার। তখন মানুষ ভাবে খোদার কি মানুষের মতই মন আছে? আর খোদার মনেবৃত্তিগুলি কি মানুষেরই অনুরূপ? ইহারও উত্তর আসে যে, উহা বুঝিবার ক্ষমতা মানুষের নাই। আবার যখন চিন্তা করা যায় যে, খোদাতা’লার জগত-শাসন প্রণালী বহুলাংশে একজন সম্রাটের মত কেন এবং তাঁর এত আমলা-কর্মচারীর বাহুল্য কেন? উহার উত্তর পাওয়া যায় যে, সম্রাট হইলে তিনি অদ্বিতীয় সম্রাট, বাদশাহের বাদশাহ্, ক্ষমতার অসীম। উত্তর যাহা পাওয়া গেল, তাহাতে অসাধারণ যাহাদের মনীষা তাঁহারা হয়ত বুঝিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ ইহাতে কিছু বুঝিতে পাইল কি?
৩। স্রষ্টা কি সৃষ্ট হইতে ভিন্ন?
ঈশ্বর যদি তাঁহার সৃষ্ট পদার্থ হইতে ভিন্ন হন, তাহা হলে তাঁহার সর্বব্যাপিত্ব থাকিতে পারে না এবং ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্ব অক্ষুণ্ন থাকিলে কোন সৃষ্ট-পদার্থ এমন কি পদার্থের অণু-পরমাণুও ঈশ্বর-শূন্য হইতে পারে না। অর্থাৎ বিশ্বের যাবতীয় পদার্থই ঈশ্বরময়। মূল কথা — বিশ্ব ঈশ্বরময়, ঈশ্বর বিশ্বময়। ধর্ম যদিও ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্বে সন্দেহ করে না, কিন্তু একথাও নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে না যে, জগতের যাবতীয় জৈব-অজৈব পাক এবং নাপাক সকল বস্তুই ঈশ্বরে ভরপুর। বিশ্বাস যদি করিত, তবে নাপাক বস্তুকে ঘৃণা করিবার কারণ কি?
এখন এই উভয় সংকট হইতে ধর্মে বিশ্বাস বাঁচাইয়া রাখার উপায় কি?
৪। ঈশ্বর কি স্বেচ্ছাচারী না নিয়মতান্ত্রিক?
‘নিয়মতন্ত্র’ হইল কোন নির্ধারিত বিধান মানিয়া চলা এবং উহা উপেক্ষা করাই হইল ‘স্বেচ্ছাচারিতা’। ঈশ্বর স্বেচ্ছাচারী হইলে তাহার মহত্ত্বের লাঘব হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক হইলে তিনি তাঁর ভক্তদের অনুরোধ রক্ষা করেন কিরূপে? সুপারিশ রক্ষার অর্থই হইল, আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করা। অর্থাৎ স্বয়ং যাহা করিতেন না, তাহাই করা। ঈশ্বর কোন ব্যক্তি বিশেষের অনুরোধ বা সুপারিশে আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করিবেন না?
৫। আল্লাহ ন্যায়বান না দয়ালু?
অন্যান্য ক্ষেত্রে যাহাই হউক না কেন, বিচার-ক্ষেত্রে ‘ন্যায়’ ও ‘দয়া’-এর একত্র সমাবেশ অসম্ভব। কেননা দয়া করিলে ন্যায়কে উপেক্ষা করিতে হইবে এবং ন্যায়কে বজায় রাখিতে হইলে দয়া-মায়া বিসর্জন দিতে হইবে। বলা হয় যে, আল্লাহ্ ন্যায়বান এবং দয়ালু। ইহা কিরূপে সম্ভব? তবে কি তিনি কোন ক্ষেত্রে ন্যায়বান আর কেন ক্ষেত্রে দয়ালু?
৬। আল্লাহর অনিচ্ছায় কোন ঘটনা ঘটে কি?
বলা হয় যে, আল্লাহ্র অনিচ্ছায় কোন ঘটনা ঘটে না। এমনকি গাছের পাতাটিও নড়ে না। বিশেষত তাঁর অনিচ্ছায় যদি কোন ঘটনা ঘটতে পারে তাহা হইলে তাঁহার ‘সর্বশক্তিমান’ নামের সার্থকতা কোথায়? আর যদি আল্লাহর ইচ্ছায়ই সকল ঘটনা ঘটে তবে জীবের দোষ বা পাপ কি?
৭। নিরাকারের সাথে নিরাকারের পার্থক্য কি?
ম‘আল্লাহ্’ নিরাকার এবং জীবের ‘প্রাণ’ও নিরাকার। যদি উভয়ই নিরাকার হয়, তবে ‘আল্লাহ’ এবং ‘প্রাণ’ — এই দুইটি নিরাকারের মধ্যে পার্থক্য কি?
৮। নিরাকার পদার্থ দৃষ্টিগোচর হয় কিরূপে?
ধর্মযাজকদের নিকট শোনা যায় যে, বেহেস্তে বিশ্বাসীগণকে আল্লাহ (নূর ও আলোরূপে) দর্শন দান করিবেন। যিনি চির অনন্ত, চির অসীম, তিনি কি চির-নিরাকার নহেন? বিজ্ঞানীদের মতে — স্থূল অথবা সূক্ষ্ম, যে রূপেই হউক না কেন, কোন রকম পদার্থ না হইলে তাহা দৃষ্টিগোচর হয় না। আলো একটি পদার্থ। উহার গতি আছে এবং ওজনও আছে। নিরাকার আল্লাহ যদি তাঁর ভক্তদের মনোরঞ্জেনের জন্য নূর বা আলো রূপ গ্রহণ করিতে পারেন, তা হলে হিন্দুদের ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশে অর্থাৎ অবতারে দোষ কি?
৯। স্থান, কাল ও শক্তি — সৃষ্ট না অসৃষ্ট?
এ কথা সত্য যে, ‘সৃষ্টিকর্তা’ বলিয়া যদি কেহ থাকেন, তবে তিনি হইবেন এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু ধর্মজগতে তাঁহাকে চিত্রিত করা হইয়াছে বিবিধ রূপে এবং তাঁহার সংজ্ঞা ও সংখ্যা সব ক্ষেত্রে এক রকম নহে। বিশেষত ধর্মরাজ্যে তাঁহার পরিচয় পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রেই ‘ব্যক্তি’ রূপে। বলা হয় যে, ঈশ্বর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার; অথচ প্রত্যক্ষে না হইলেও পরোক্ষে তাঁহার চোখ, মুখ ও কান আছে — তাহার আভাস পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে। এমন কি তাঁহার পুত্র-কন্যা-পরিবারেরও বর্ণনা পাওয়া যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। সৃষ্টিকর্তা হইলেন — যিনি সৃষ্টি করেন বা করিয়াছেন। কোন সৃষ্ট পদার্থ স্রষ্টার চেয়ে বয়সে অধিক হইতে পারে না, এমন কি সমবয়সীও না। কোন কুমার একটি হাড়ি তৈয়ার করিল, এক্ষেত্রে হাড়ি কখনও কুমারের বয়োঃজ্যেষ্ঠ বা সমবয়সী হইতে পারে না। অর্থাৎ কর্তার আগে কর্ম অথবা কর্তা ও কর্ম একই মুহূর্তে জন্মিতে পারে না, ইহাই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম।
কোন পদার্থের সৃষ্টিকাল যতই অতীত বা মহাতীত হউক না কেন, উহা কখনও অনাদি হইতে পারে না। যাহা ‘সৃষ্টি’ তাহা নিশ্চয়ই কোন এক সময়ে উৎপত্তি হইয়া থাকিবে। কিন্তু বিশ্বে এমন কোন কোন বিষয় আছে, আমরা যাহার আদি, অন্ত, সীমা ও আকার কল্পনা করিতে পারি না। যেমন, স্থান, কাল ও শক্তি। বলা হইয়া থাকে যে, ঈশ্বর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। পক্ষান্তরে স্থান, কাল এবং শক্তিও অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। যথা ক্রমে এ বিষয় আলোচনা করিতেছি।
১. স্থান — বিশ্বের দৃশ্যাদৃশ্য যাবতীয় পদার্থই কোন না কোন স্থানে অবস্থিত আছে। ‘স্থান’ (Space) পদার্থপূর্ণ অথবা পদার্থশূন্য, দুইই থাকিতে পারে। কিন্তু ‘স্থান’কে থাকিতেই হইবে।
বিশ্বের যাবতীয় পদার্থই কোন না কোন সময়ে উৎপত্তি হইয়াছে। এমন কি পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে সৃষ্টির দিন-তারিখও দেওয়া আছে। সে যাহা হউক, কোন কিছু বা সব কিছু সৃষ্টির পূর্বে — পদার্থশূন্য থাকিলেও যে ‘স্থান’ ছিল না, তাহা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং বলিতে হয় যে, ‘স্থান অনাদি।‘
পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রাদি সৃষ্টি হইয়া কোন ‘স্থান’ এ অবস্থান করিতেছে এবং উহারা বিলয় হইলেও ঐ স্থান সমূহ থাকিবে। কেননা শূন্য স্থান কখনও বিলয় হইতে পারে না। সুতরাং বলিতে হয় যে ‘স্থান অনন্ত’।
পরম বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলিয়াছেন, “বিশ্ব অসীম অথচ সসীম।” অর্থাৎ নক্ষত্র-নিহারিকাদর পার্থিব জগত সসীম, কিন্তু ‘স্থান’ অসীম। বিশ্বের ‘শেষ প্রান্ত’ বলিয়া এমন কোন সীমারেখা কল্পনা করা যায় না, যাহার বহির্ভাগে আর ‘স্থান’ নাই। সুতরাং “স্থান অসীম”।
আমরা দেখিতে বা অনুভব করিতে পারি শুধু পদার্থকে, স্থানকে নয়। স্থান পদার্থের ন্যায় লাল, কালো, সবুজাদি রং এবং লম্বা-চওড়া ইত্যাদি আকৃতি বিশিষ্ট নয়। স্থানের কোন অবয়ব নাই। উহা আকৃতিহীন ও অদৃশ্য। অর্থাৎ নিরাকার।
২. কাল — কাল বা সময়কে আমরা দেখিতে পাই না, দেখিতে পাই শুধু ঘটনাকে। কেহ কেহ বলেন যে ‘কাল’ বা ‘সময়’ নামে কোন কিছু নাই, ‘কাল’ হইল ঘটনা পর্যায়ের ফাঁক মাত্র। সাধারণত কালকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করিয়া থাকি। যথা — ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান। কিন্তু কেহ কেহ বলে যে ‘বর্তমান’ নামে কোন কালই নাই। কেননা কাল সতত গতিশীল। যাহা গতিশীল তাহার স্থিরতা বা বর্তমানতা অসম্ভব। ভবিষ্যৎ হইতে কাল তীব্রগতিতে আসে এবং নিমেষে অতীতে চলিয়া যায়। এক সেকেণ্ডকে হাজার ভাগ করিলে যে সময়টুকু পাওয়া যায়, সেই সময়টুকু কাল দাঁড়াইয়া থাকে না ‘বর্তমান’ নামে আখ্যায়িত হইবার প্রত্যশায়। বর্তমান হইল — অতীত এবং ভবিষ্যতের সন্ধিস্থল মাত্র। উহার কোন বিন্দুতেই কাল এতটুকু স্থিত বা বর্তমান থাকে না। তবে আমরা যে বর্তমান যুগ, বর্তমান বৎসর, বর্তমান ঘটনা ইত্যাদি বলিয়া থাকি, উহা হইল অতীত এবং ভবিষ্যতের সংমিশ্রণ। যাক সে কথা।
ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করিয়াছেন কোন এক সময়ে। কিন্তু ‘সময়’ কে সৃষ্টি করিয়াছেন কোন সময়ে, তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। এরূপ কল্পনা করা মোটেই কষ্টকর নয় যে, এমন একটি সময় ছিল, যখন কোনরূপ সৃষ্টিই ছিল না। কিন্তু সৃষ্টির পূর্বে যে, ‘কাল’ ছিল না, তাহা কল্পনা করা যায় না। কাজেই বলিতে হয় যে, কাল ‘অনাদি’। পক্ষান্তরে — মহাপ্রলয়ে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হইবার পর — কাল আর থাকিবে না, তাহাও মানব কল্পনার বাহিরে। সুতরাং বলিতে হয় যে, কাল ‘অনন্ত’।
বিশ্বে, মহাবিশ্ব অথবা আরও বাহিরে এমন কোন জায়গা নাই, যেখানে কাল নাই। কালকে কোন স্থানে সীমিত রাখা যায় না। সুতরাং কাল ‘অসীম’। অধিকন্তু কাল ‘নিরাকার’ও বটে।
৩. শক্তি — ‘শক্তি’ বলিতে আমরা বুঝি যে, উহা কাজ করিবার ক্ষমতা। শক্তিকে জানিতে বেশী দূরে যাইতে হয় না। কেননা উহা আমাদের নিজেদের মধ্যেই আছে, যাহার সাহায্যে আমরা উঠা-বসা, চলা-ফেরা ও নানাবিধ কাজকর্ম করিয়া থাকি। কিন্তু শুধু গায়ের শক্তিতেই সকল রকম কাজ করা যায় না, অন্যান্য রকম শক্তিরও দারকার। গায়ের শক্তিতে কোন কিছু দেখা বা শোনা যায় না, গায়ে জোর থাকা সত্ত্বেও অন্ধ বা বধির ব্যক্তিরা দেখে না বা শোনে না, উহার জন্য চাই দর্শন ও শ্রবণ শক্তি। শুধু তাই নয়, আরও অনেক রকম শক্তি আমাদের দরকার এবং উহা আছেও। যেমন — বাকশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, স্পর্শশক্তি, ধীশক্তি, মননশক্তি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি জীবনীশক্তি। আমাদের দেহের মধ্যে যেমন রকম-রকম শক্তি আছে, তেমন প্রকৃতিরাজ্যেরও নানাবিধ শক্তি আছে; যেমন — তাপশক্তি, আলোকশক্তি, বিদুৎশক্তি, রাসায়নিক শক্তি ইত্যাদি।
বস্তুজগতে এমন কোন বস্তু নাই, যাহার মধ্যে কোনরূপ শক্তি নাই। সামান্য একটি দুর্বাপত্রেরও রোগ নিরাময় করিবাব শক্তি আছে। মূল কথা এই যে, এই জগৎটাই শক্তির লীলাখেলা। অর্থাৎ — শক্তি জগৎময় এবং জগৎ শক্তিময়।
বিজ্ঞানী প্রবর আইনস্টাইন বলিয়াছেন যে, ‘পদার্থ’ শক্তির রূপান্তর মাত্র। শক্তি সংহত হইয়া হয় পদার্থের উৎপত্তি এবং পদার্থের ধ্বংসে হয় শক্তির উদ্ভব। কি পরিমাণ শক্তির সংহতিতে কি পরিমাণ পদার্থ এবং কি পরিমাণ পদার্থ ধ্বংসে কি পরিমাণ শক্তির উদ্ভব হইতে পারে, তাহা তিনি অংকের সাহায্যে দেখাইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, একটি মটর পরিমাণ পদার্থকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করিতে পারিলে তাহা হইতে যে শক্তির উদ্ভব হইবে, তাহা দ্বারা বড় রকমের একখানা মালবাহী জাহাজ চালানো যাইবে লণ্ডন হইতে নিউইয়র্ক পর্যন্ত। আইনস্টাইনের এই সূত্র ধরিয়াই অধুনা হইয়াছে পারমাণবিক শক্তির আবিষ্কার। ইহাতে জানা যাইতেছে যে, এই জগতে জৈবাজৈব সমস্ত পদার্থই শক্তির রূপান্তর। অর্থাৎ জগতের সব কিছু সৃষ্টির মূলে রহিয়াছে ‘শক্তি’।
কোনরূপ কাজ করিতে হইলেই আগে চাই সেই কাজটি সমাধা করিবার মত শক্তি। অর্থাৎ শক্তি আগে ও কাজ পরে। এই জগত ঈশ্বর সৃষ্টি করিয়াছেন এবং সেই সৃষ্টিকাজেও তাঁর আবশ্যক হইয়াছিল শক্তির। যখন হইতে ঈশ্বর আছেন, তখন হইতে তাঁহার শক্তিও আছে। আমরা এমন একটা সময়কে কল্পনা করিতে পারি না, যখন ঈশ্বর ছিলেন অথচ তাঁহার শক্তি ছিল না। ঈশ্বর অনাদি। কাজেই শক্তিও ‘অনাদি’। পক্ষান্তরে আমরা এমন একটা সময়কে কল্পনা করিতে পারি না যখন কোনরূপ পদার্থ না থাকিলেও শক্তি থাকিবে না। কাজেই মানিতে হয় যে, ‘শক্তি অনন্ত’।
কোন পদার্থ বা পদার্থের অণুপরমাণুও যেমন শক্তিবিহীন নয়, তেমন সৌরজগত, নক্ষত্র বা নীহারিকাজগত অথবা তাহারও বহির্দেশের কোথায়ও শক্তি বিরল জায়গা নাই। শক্তি কোন স্থানে সীমিত নয়। অর্থাৎ ‘শক্তি অসীম’। তাপশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, চুম্বকশক্তি ইত্যাদি নানাবিধ শক্তির আমরা ক্রিয়া দেখিতেছি। কিন্তু কখনও শক্তিকে দেখিতে পাইতেছি না। আমরা প্রাণশক্তিবলে বাঁচিয়া আছি এবং নানা রূপ কর্ম করিতেছি। কিন্তু প্রাণশক্তিকে দেখিতে পাইতেছি না। কেননা, শক্তির কোন আকার নাই, ‘শক্তি নিরাকার’।
এ যাবত যে সমস্ত আলোচনা করা হইল, তাহাতে মনে হয় যে, ঈশ্বর যেমন অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার তেমন স্থান, কাল ও শক্তি — ইহারা সকলেই অনাদি, অনন্ত, অসীম এবং নিরাকার। এখন প্রশ্ন এই যে, ইহারা কি সৃষ্ট না অসৃষ্ট। অর্থাৎ ঈশ্বর কি ইহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন, না অনাদিকাল হইতে ইহারা স্বভাবতই বিদ্যমান আছে? যদি বলা হয় যে, ইহারা স্বাভাবতই বিদ্যমান আছে, তাহা হইলে ইহারা ঈশ্বরের সৃষ্টি নহে এবং যদি বলা হয় যে, ইহারা ঈশ্বরের সৃষ্টি — তবে পরমেশ্বর ‘স্থান’-কে সৃষ্টি করিলেন কোন স্থানে থাকিয়া, ‘কাল’-কে সৃষ্টি করিলেন কোন কালে এবং ‘শক্তি’-কে সৃষ্টি করিলেন কোন শক্তির দ্বারা?
১০। সৃষ্টি যুগের পূর্বে কোন যুগ?
ধর্মীয় মতে, হঠাৎ পরমেশ্বরের খেয়াল হইল যে, তিনি সৃষ্টি করিবেন জীব ও জগত। তিনি আদেশ দিলেন ‘হইয়া যাও’ — অমনি হইয়া গেল জগত এবং পশু-পাখি, গাছপালা, কীট-পতঙ্গ ও মানুষ্যাদি সবই। বিশ্বচরাচরের যাবতীয় সৃষ্টিকার্য শেষ হইতে সময় লাগিল মাত্র ছয়দিন।১ কিন্তু অনাদিকাল নিষ্ক্রিয় থাকিয়া পরমেশ্বর হঠাৎ সক্রিয় হইলেন কেন, ধর্মযাজকগণ তাহা ব্যাখ্যা করেন না। জীব ও জগতে সৃষ্টির পর হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়কে মানুষ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করিয়াছে। উহার এক এক ভাগকে বলা হয় এক-একটি যুগ । হিন্দু শাস্ত্র মতে যুগ চারিটি। যথা — সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। উহাদের ব্যাপ্তিকাল যথাক্রমে — সত্যযুগ ১৭,২৮,০০০, ত্রেতা যুগ ১২,৯৬,০০০, দ্বাপর ৮,৬৪,০০০, এবং কলি ৪,৩২,০০০ বৎসর। আলোচ্য যুগচতুষ্ঠয়ের মোট বয়সের পরিমাণ ৪৩,২০,০০০ বৎসর। কিন্তু কলি যুগটি শেষ হইতে এখনও প্রায় ৪,২৭,০০০ বৎসর বাকি।২ সুতরাং আলোচ্য যুগচতুষ্টয়ের অতীত বয়স মাত্র ৩৮,৯৩,০০০ বৎসর [ইহা বিজ্ঞানীদের সর্বাধুনিক প্লিস্টোসেন উপযুগটির সমানও নহে। এই উপযুগটির বর্তমান বয়স প্রায় ৫০ লক্ষ বৎসর]।
পবিত্র বাইবেল গ্রন্থের মতে জীব ও জগত সৃষ্টি হইয়াছে খৃ.পূ. ৪০০৪ সালে৩ এবং বর্তমানে খৃঃ ১৯৭২ । সুতরাং, এই মতে জগতের বর্তমান বয়স ৫৯৭৬ বৎসর। অর্থাৎ প্রায় ছয় হাজার বৎসর (ইহা হাস্যকররূপে অল্প)।
কাইপারাদি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৫০০ কোটি বৎসর পূর্বে আমাদের সূর্যের সৃষ্টি হইয়াছিল এবং তাহারও ৫০০ কোটি বৎসর পূর্বে সৃষ্টি হইয়াছিল আমাদের নক্ষত্র জগত। কোন কোন বিজ্ঞানীর মতে আমাদের পৃথিবীর বয়স ৪০০ কোটি বৎসর।৪
উক্ত চারিশত কোটি বৎসরকে বিজ্ঞানীগণ (ভুগর্ভস্থ স্তরসমূহের ক্রমানুসারে) কয়েকটি যুগ বা উপযুগে বিভক্ত করিয়াছেন। এখন হইতে ৫০ কোটি বৎসর পূর্বের যাবতীয় সময়কে একত্রে বলা হয় প্রাক ‘ক্যামব্রিয়ান মহাযুগ’ (Archaeo Zoic)। এই যুগের প্রথম দিকে পৃথিবীতে কোনরূপ জীব বা জীবনের অস্তিত্ব ছিল না। এই যুগটি অতিবাহিত হইয়াছিল - জ্বলন্ত পৃথিবী নির্বাপিত হইয়া তরল ও কঠিন হইতে এবং উত্তাপ কমিয়া জল-বায়ু সৃষ্টি হইয়া প্রাণীদের যুগ (Placo Zoic) ৩১ কোটি বৎসর, মধ্যজীবীয় যুগ বা সরীসৃপদের যুগ (Meso Zoic) ১২ কোটি বৎস ও নবজীবীয় যুগ বা স্তন্যপায়ীদের যুগ (Caino Zoic) ৭ কোটি বৎসর (এই যুগটি এখনও চলিতেছে)।৫
জীববিজ্ঞানীদের মতে, প্রাক ক্যামব্রিয়ান মহাযুগের শেষের দিকে পৃথিবীতে জীবন বা জীবের সূত্রপাত হইয়াছিল মাত্র এবং উহা ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ পাইয়াছে নবজীবীয় যুগে। এই যুগেই হইয়াছে পশু, পাখী, মানুষ ইত্যাদি উন্নত মানের জীবের আবির্ভাব।
আলোচ্য যাবতীয় যুগের ব্যাপ্তিকাল কোন মতে মাত্র ছয় হাজার বৎসর এবং কোন মতে এক হাজার কোটি বৎসর। ধর্ম বা বিজ্ঞান, যে কোন মতেই হউক না কেন, সৃষ্টির পর হইতেই যুগ গণনা করা হইয়া থাকে। তাই সামগ্রিকভাবে ইহাকে আমরা বলিতে পারি ‘সৃষ্টি-যুগ’। এই সৃষ্টি যুগেই দেখা যায় সৌরজগত, নক্ষত্রজগত ইত্যাদির পরিচালন এবং জীব জগতের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ-পোষণ ইত্যাদি পরমেশ্বরের যত সব কর্ম-তৎপরতা।
ঈশ্বর অনাদি এবং ‘কাল’ও অনাদি। কিন্তু যুগসমূহ অনাদি নয়, উহা সাময়িক। যখন হইতে ঈশ্বর আছেন, তখন হইতে কালও আছে। সেই ‘অনন্ত কাল’-এর সাথে কয়েক হাজার বা কোটি বৎসর সময়ের তুলনাই হয় না। এমন এক কাল নিশ্চয়ই ছিল যখন, কোনরূপ সৃষ্টিই ছিল না। সেই ‘অনাদি কালকে’ আমরা বলিতে পারি ‘অনাদি যুগ’ বা ‘অসৃষ্ট-যুগ’। সেই অনাদি-অসৃষ্ট যুগে পরমেশ্বর কি করিতেন?
১১। ঈশ্বর কি দয়াময়?
‘দয়া’ একটি মহৎ গুণ, এই গুণটির অধিকারীকে বলা হয় ‘দয়াবান’। মানুষ ‘দয়াবান’ হইতে পারে, কিন্তু ‘দয়াময়’ হইতে পারে না। কেননা মানুষ যতই ঐ গুণটির অধিকারী হউক না কেন, উহাতে পূর্ণতা লাভ করিতে পারে না। আর ঈশ্বর ঐ গুণে পূর্ণ, তাই তাঁহার একটি নাম ‘দয়াময়’।
কোন ব্যক্তি যদি একজন ক্ষুধার্থকে অন্নদান ও একজন পথিকের মাল লুণ্ঠন করে, একজন জলমগ্নকে উদ্ধার করে ও অন্য কাউকে হত্যা করে অথবা একজন গৃহহীনকে গৃহদান করে এবং অপরের গৃহ করে অগ্নিদাহ — তবে তাহাকে ‘দয়াময়’ বলা যায় কি? হয়ত ইহার উত্তর হইবে – ‘না’। কিন্তু উত্তরূপ কার্যকলাপ সত্ত্বেও ঈশ্বর আখ্যায়িত আছেন ‘দয়াময়’ নামে। এখন সে বিষয় কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাইতেছে।
জীবজগতে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন কোন সবল প্রাণী দুর্বল প্রাণীকে ধরিয়া ভক্ষণ করে, তখন ঈশ্বর খাদকের কাছে ‘দয়াময়’ বটে। কিন্তু তখন তিনি কি খাদ্য-প্রাণীর কাছেও দয়াময়? যখন একটি সর্প একটি ব্যাংকে ধরিয়া আস্তে আস্তে গিলিতে থাকে, তখন তিনি সর্পটির কাছে দায়ময় বটে। কিন্তু ব্যাঙটির কাছে তিনি নির্দয় নহেন কি? পক্ষান্তরে তিনি যদি ব্যাঙটির প্রতি সদয় হ’ন, তবে সর্পটি অনাহারে মারা যায় না কি? ঈশ্বর এক জীবকে অন্য জীবের খাদ্য নির্বাচন না করিয়া নির্জীব পদার্থ অর্থাৎ সোনা, রূপা, লোহা, তামা, মাটি, পাথর ইত্যাদি নির্বাচন করিতে পারিতেন কি না? না পারিলে কেঁচোর খাদ্য মাটি হইল কিরূপে? ঈশ্বরের সৃষ্টি জীবেরা সকলেই তাঁর দয়ার সমানাংশ প্রাপ্তির দাবীদার। কিন্তু তাহা পাইতেছে কি? খাদ্য সম্বন্ধে বলা যায় যে, ঈশ্বর মানুষের জন্য চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় ইত্যাদি অসংখ্য রকম খাদ্যের ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং পশু-পাখীদের জন্য বরাদ্দ করিয়াছেন ঘাস-বিচালী, পোকা-মাকড় আর কুকুরের জন্য বিষ্ঠা। ইহাকে ঈশ্বরের দয়ার সমবণ্টন বলা যায় কি?
কাহারও জীবন রক্ষা করা যদি দয়ার কাজ হয় এবং হত্যা করা হয় নির্দয়তার কাজ, তাহা হইলে খাদ্য-খাদক ব্যাপারে ঈশ্বর ‘সদয়’-এর চেয়ে ‘নির্দয়’-ই বেশী। তবে কতগুণ বেশী, তাহা তিনি ভিন্ন অন্য কেহ জানে না, কেননা তিনি এক একটি জীবের জীবন রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অসংখ্য জীবকে হত্যা করিয়া থাকেন। কে জানে একটি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য তিনি কয়টি মাছ, মোরগ, ছাগল ইত্যাদি হত্যা করেন? কে জানে তিনি একটি শোল, গজাল, বোয়াল মাছ এবং একটা বক পাখীর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে কয়টি চুনো মাছ হত্যা করেন? আমিষ ভোজী জীবদের প্রতি ঈশ্বরের এত অধিক দয়া কেন? তিনি কি হতভাগাদের ‘দয়াময়’ নহেন?
বলা হইয়া থাকে যে, মানুষ ঈশ্বরের সখের সৃষ্ট-জীব। তাই মানুষের উপর তাঁর দয়া-মায়াও বেশী। কিন্তু মানুষ ভেদে তাঁর দয়ার তারতম্য কেন? ঈশ্বর দয়া করিয়া সকল মানুষকেই প্রাণদান করিয়াছেন এবং দান করিয়াছেন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও সুখ-দুঃখের অনুভূতি সমান মাপে। অথচ মানুষের জীবিকা নির্বাহের কোন ব্যাপারেই ঈশ্বরের দয়ার সমবণ্টন নাই কেন? কেহ সুরম্য হর্মে বাস করে সাত তলায় এবং কেহ বা করে গাছ তলায়। কেহ পঞ্চামৃত (দুগ্ধ-দধি-ঘৃত-মধু-চিনি) আহার করে এবং কেহ জল ভাতে শুধু লবণ ও লঙ্কা পোড়া পায় না কেন? কেহ লম্ফ-ঝম্প ও দৌড় প্রতিযোগিতায় রেকর্ড করে, কেহ মল্ল যুদ্ধে পদক পায়। আবার অন্ধ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গেরা রাস্তায় বসিয়া অন্যের পায়ের আঘাত পায়। ঈশ্বরের দয়া বণ্টনে এরূপ পক্ষপাতিত্ব কেন? আর ‘ভাগ্য’ বলিয়া কিছু আছে কি-না? থাকিলে কাহারও ভাগ্যে চির শান্তি নাই কেন? ভাগ্যের নিয়ন্তা কে?
কাহারও জীবন রক্ষা করা দয়ার কাজ বটে, কিন্তু কাহাকেও বধ করা দয়ার কাজ নহে। বরং উহা দয়াহীনতার পরিচয়। জগতে জীবের বিশেষত মানুষের জন্মসংখ্যা যত, মৃত্যুসংখ্যা তত। সুতরাং জন্ম ও মৃত্যুর ব্যাপারে ঈশ্বর যেই পরিমাণ সদয়, সেই পরিমাণ নির্দয়, অর্থাৎ ঈশ্বরের সদয়তা ও নির্দয়তার পরিমাণ এক্ষেত্রে সমান।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কেহ কেহ মনে করেন যে, ঈশ্বর সদয়ও নহেন এবং নির্দয়ও নহেন। তিনি নিরাকার, নির্বিকার ও অনির্বচনীয় এক সত্তা। যদি তাহা নাই হয়, তবে পৃথিবীতে শিশু মৃত্যু, অপমৃত্যু, এবং ঝড়-বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প ইত্যাদিতে প্রাণহানিজনক ঘটনাগুলির জন্য তিনিই কি দায়ী নহেন?
টীকাসমূহ
১. পবিত্র কোরান (সুরা সেজদা) – আয়াত ১:৪
২. সরল বাংলা অভিধান, সুরলচন্দ্র মিত্র, পৃষ্ঠা. ৩০০
৩. মানব মনের আযাদি, আবুল হাসনাৎ, পৃষ্ঠা. ৬৭
৪. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ৪৪
৫. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১৫০, ১৫১
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1797#sthash.XUi5lZ1H.dpuf
১। জীব সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?
কেহ কেহ বলেন যে, মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য হইল আল্লাহ্র নাম ও গুণ কীর্তন করা। তাই যদি হয়, তাহা হইলে ইতর জীব সৃষ্টির কারণ কি? তাহারাও যদি ঐ পর্যায়ে পড়ে, তাহা হইলে তাহাদেরও বিচারান্তে স্বর্গ বা নরকবাসী হওয়া উচিত। কিন্তু তাহা হইবে কি? বলা হয় যে, মানুষ ও ইতর জীবের মধ্যে জ্ঞানের বৈষম্য আছে, তাই পরকালেও উহাদের মধ্যে বৈষম্য থাকিবে। বৈষম্য আছে বটে, কিন্তু একবারেই জ্ঞানহীন কোন জীব আছে কি? অতি ক্ষুদ্র পিপীলিকা হইতে অতি বৃহৎ হস্তী অবধি প্রত্যেকেই ন্যুনাধিক জ্ঞানের অধিকারী। কাক, শৃগাল, বানর, গরিলা, শিম্পাজী ইত্যাদির বুদ্ধিবৃত্তির নিকট সময় সময় সুচতুর মানুষও হার মানে এবং বোল্তা, ভীমরুল, মধুমক্ষিকা, উই পোকা ও বাবুই পাখীর গৃহ নির্মাণের কৌশলের কাছে মানুষের জ্ঞানগরিমা ম্লান হইয়া যায়। আবার মানুষের মধ্যেও এমন কতগুলি অসভ্য ও হাবা (বোকা) শ্রেণীর মানুষ দৃষ্ট হয়, যাহারা জ্ঞানের মাপকাঠিতে মনুষ্য পদবাচ্য নহে। তাহারা সৃষ্টি হইল কোন উদ্দেশ্যে?
২। পাপ-পুণ্যের ডায়রী কেন?
ধর্মযাজকগণ বলিয়া থাকেন যে, মানুষের পাপ-পুণ্য লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য প্রত্যেকটি মানুষের কাঁধে দুইজন করিয়া ফেরেস্তা বসিয়া আছেন। তাঁহারা আরও বলিয়া থাকেন যে, ঐ ফেরেস্তাদের রিপোর্ট অনুসারেই খোদাতা’লা মানুষের পাপ-পুণ্যের বিচার করিবেন। বলা হয় যে আল্লাহ্ সর্বদর্শী ও সর্বশক্তিমান। তবে মানুষের কৃত পাপ-পুণ্য তিনি কি নিজে দেখেন না? অথবা দেখিলেও মানুষের সংখ্যাধিক্যের জন্যই হউক অথবা সময়ের দীর্ঘতার জন্যই হউক, বিচার দিন পর্যন্ত উহা স্মরণ রাখিবার ক্ষমতা তাঁহার নাই কি?
৩। পরলোকের সুখ-দুঃখ শারীরিক, না আধ্যাত্মিক?
জীবের মৃত্যুর পর তার দেহটা রূপান্তরিত হইয়া পৃথিবীর কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থে পরিণত হয়। আবার ঐ সকল পদার্থের অণু-পরমাণুগুলি নানা উপায় গ্রহণ করিয়াই হয় নতুন জীবের দেহ গঠন। জীবদেহের ত্যাজ্য ময়লা। আবার মৃত্যুর পর আমার এই দেহের উপাদানে হইবে লক্ষ লক্ষ জীবের দেহ গঠন। মনে করা যাক — কোন এক অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ডাক্তারকে দিয়া একটি পাঁঠার দেহের প্রতিটি অণু বা কোষ (Cell) কোন উপায়ে চিহ্নিত করা হইল, যাহাতে যে কোন স্থান হইতে উহাদিগকে চিনিয়া বাহির করা যায়। এখন যদি ঐ পাঁঠাটি কোন এক ভোজ সভায় পাক করিয়া একশত লোককে ভোজন করান যায় এবং বাকি ত্যাজ্য অংশ — শৃগাল, কুকুর, কাক, শকুন, পিপীলিকা ইত্যাদিতে খাইয়া ফেলে তাহা হইলে কিছুকাল পরে ঐ পাঁঠাটির দেহটা পুনর্গঠন করিতে কতগুলি জীবদেহ কর্তন (Operation) করিতে হইবে? চিহ্নিত অংশগুলিকে চিনিয়া বাহির করিতে পারিলেও যতগুলি প্রাণী ঐ পাঁঠাটির দেহ ভক্ষণ করিয়াছিল ততগুলি প্রাণীর দেহ কর্তন না করিয়া কোন মতেই ঐ পাঁঠাটির দেহ পুনর্গঠন সম্ভব হইবে না। ইহাতে দেখা যাইতেছে যে, প্রাণী বিশেষের দেহ অন্যান্য বহু প্রাণীর দেহ হইতে আহৃত পদার্থ সমূহের সমষ্টির ফল। অর্থাৎ যে কোন একটি জীবের দেহ অন্যান্য বহু জীবের দেহ হইতে উদ্ভুত হইতেছে। এমতাবস্থায় পরকালে একই সময় যাবতীয় জীবের দেহে বর্তমান থাকা কি সম্ভব? যদি হয়, তবে প্রত্যেক দেহে তাহাদের পার্থিব দেহের সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যমান থাকিবে কিরূপে? যদি না থাকে, তবে স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ কি আধ্যাত্মিক?
স্বর্গ-নরকের সুখ-সুঃখ ও গোর-আজাব সম্বন্ধে যে সমস্ত বিবরণ শোনা যায়, তার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা চলে না। শোনা যায় যে, মৃত্যুর পরে শবদেহকে কবরের ভিতরে পুনর্জীবিত করা হয় এবং ‘মনকির’ ও ‘নকির’ নামক দুইজন ফেরেস্তা আসিয়া প্রত্যেক মৃতকে তার ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করে। যাহারা পাপী, তাহারা প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না বলিয়া তাহাদের উপর ঐ ফেরেস্তাদ্বয় অমানুষিক অত্যাচার চালায়। গুর্জের (গদার?) আঘাতে দেহ ৭০ গজ নীচে প্রোথিত হইয়া যায়। আবার তাহারা উহাকে পুনরোত্তলন করিয়া লয়। দোজখ হইতে সুরঙ্গপথে আগুণের উত্তাপ আসিয়া পাপী-দিগকে বিচারদিন পর্যন্ত জ্বালাইতে থাকে। অবশ্য পুণ্যবাণ ব্যক্তিগণ সুরঙ্গ পথে বেহেস্তের সুবাসিত মলয় বায়ু উপভোগ করিতে থাকেন।
দোজখের শাস্তির বর্ণনায় শোনা যায় যে, পাপীদিগকে পুঁজ, রক্ত, গরম পানি ইত্যাদি খাইতে দেওয়া হইবে, সূর্যের অত্যধিক উত্তাপে পাপীদের মস্কিষ্ক বিগলিত হইয়া যাইবে। চক্ষুর সাহায্যে পাপী যে পাপ করিয়াছে — যেমন যে পাপী পরস্ত্রী দর্শন করিয়াছে, তাহার চক্ষুকে শাস্তি দেওয়া হইবে। এইরূপ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদিও যাহাদের সাহায্যে কোন প্রকার পাপ করা হইয়াছে, সেই সমস্ত পাপের জন্য ঐ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শাস্তি হইয়া থাকিবে।
বেহেস্তের সুখের বর্ণনায় শোনা যায় যে, পুণ্যবানগণ নানা রকম সুমিষ্ট সুস্বাদু ফল আহার করিবেন, নেশাহীন মদিরা পান করিবেন, হুরীদের সহবাস লাভ করিবেন — এক কথায় প্রত্যেক পুণ্যবান ব্যক্তি মধ্যযুগের এক একজন সম্রাটের ন্যায় জীবন যাপন করিবেন।
ঐ সকল বর্ণনা হইতে বুঝা যায় যে, পারলৌকিক সুখ-দুঃখ ভোগ ও অন্যান্য কার্যকলাপ কোনটাই আধ্যাত্মিক অর্থে বর্ণিত হয় নাই, বরং দৈহিক রূপেই বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু ঐ সকল ব্যাপার সকলই যে দৈহিক, এ কথাও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চলে না। এই দুই প্রকার ব্যাখ্যার মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনটি?
৪। গোর আজাব কি ন্যায়সঙ্গত?
বলা হইয়া থাকে যে, খোদাতা’লাই একমাত্র পাপ-পুণ্যের বিচারক। মৃত্যুর পর সকল জীব বিচারদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে এবং প্রমাণাদি গ্রহণ পূর্বক বিচারের পরে পাপী দোজখে এবং পুণ্যবান বেহেস্তে যাইবে। কিন্তু একথাও বলা হইয়া থাকে যে, মৃতকে কবরস্থ করার পরই মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় আসিয়া নানারূপ প্রশ্ন করিবেন এবং সন্তোষজনক জবাব না পাইলে তাঁহারাই শাস্তি দেওয়া আরম্ভ করিবেন। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, পাপীদের প্রতি গোর আজাব কেন, খোদাই যদি পাপ-পুণ্যের বিচার করেন এবং বিচারের পরেই যদি পাপীর নরক এবং পুণ্যবানের স্বর্গসুখ ভোগ করিতে হয়, তবে বিচারের পূর্বে পাপী ও পুণ্যবান ন্যায়বিচারক আল্লাহর কাছে একই রকম ব্যবহার আশা করিতে পারে না কি? যদি বলা হয় যে, ঐ গোর আজাব ভোগ পাপীর পাপকর্মেরই ফল, খোদার হুকুমের শাস্তি, — তাহা হইলে বিচারদিনে বিচারের প্রহসন করার প্রয়োজন কি? আল্লাহ্ সর্বজ্ঞাতা। মৃত্যুর পর হইতেই তিনি পাপীকে নরক ও পুণ্যবানকে স্বর্গসুখ ভোগ করাইতে পারেন না কি? গোর আজাবের বর্ণনা করিলে বুঝা যায় যে, উহা একমাত্র ভূগর্ভেরই আজাব, ভূ-পৃষ্ঠের নহে। সচরাচর দেখা যায় যে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় বহুলোক মারা যায়, যাহাদের লাশ কবরস্থ হয় না। উহারা জলে-স্থলে ইতস্তত পড়িয়া থাকিয়া শিয়াল-কুকুর ও কাক-শকুনের ভক্ষ হয়। উহাদের গোর আজাব হয় না কি? হইলে কিরূপ হয়?
ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমানাদি (Semitic) জাতিরাই লাশ মাটিতে পুঁতিয়া রাখে, অন্যান্য জাতিরা ইহা করে না। তাহারা কেহ লাশ জলে ভাসাইয়া দেয়, কেহ মাঠে ফেলিয়া রাখে, কেহ পর্বতের চূড়ায় রাখিয়া দেয়, কেহ গাছের শাখায় ঝুলাইয়া রাখে এবং কেহবা আগুনে জ্বালাইয়া দেয়। এইভাবে যে সকল মানুষ পরজগতের যাত্রী হয়, তাহাদের গোর আজাব হয় না কি? যদি হয়, তবে কিরূপে? আর যদি না হয়, তবে লাশকে কবরে রাখিয়া লাভ কি?
কঠিন বা সহজ যেভাবেই হোক গোর আজাবের সময়সীমা লাশকে কবরস্থ করার পর হইতে কেয়ামত (মহাপ্রলয়) পর্যন্ত। মনে করা যাক যে, কোন একজন পাপী মরণান্তে লক্ষ বৎসর গোর আজাব ভোগের পর কেয়ামত হইল, অর্থাৎ সে ব্যক্তি একলক্ষ বৎসর গোর আজাব ভোগ করিল। আবার ঐ ব্যক্তির সমান পাপে আর এক ব্যক্তি মারা গেল কেয়ামতের দুই দিন পূর্বে। এ ক্ষেত্রে ঐ উভয় ব্যক্তির গোর আজাব ভোগের পরিমাণ সমান হইল কি?
৫। পরলোকের স্বরূপ কি?
‘পরকাল’ থাকিলে ‘পরলোক’ বা পরজগত নিশ্চয়ই থাকিবে কিন্তু পরকাল সম্বন্ধে দাবীটা যত অধিক জোরালো এবং পরিষ্কার, পরজগত বিষয়ে বিবরণটি তত অধিক ঘোরালো বা অস্পষ্ট। ইহজগতে মানুষের স্থিতিকাল নিতান্তই অল্প, বড় জোর ৬০, ৭০ কিংবা ১০০ বৎসর। মানুষ এই সামান্য সময়ের জন্য পৃথিবীতে বাস করিতে আসিয়া তার বহুমুখী জ্ঞানপিপাসা মিটাইবার জন্য আকাশ, পাতাল, সাগর, পাহাড় সর্বত্রই বিচরণ ও পর্যবেক্ষণ করিতেছে। এমন কি পদার্থের অণুকে দেখিয়া এখন পরমাণুকে ভাঙ্গিয়া তার শক্তি পরীক্ষা ও ব্যবহার করিতেছে। আর তাহার অনন্তকাল বাসের আবাস যে পরজগত, তাহা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা একান্তই ভাসা-ভাসা। ধর্মগুরুদের আধ্যাত্মিক পর্যটনের বিবরণ হইতে পরজগতের একটা ভৌগোলিক সংজ্ঞা প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাঁহাদের বিবরণ মতে পর জগত তিন ভাবে বিভক্ত। যথা — হাশর মাঠ, বেহেস্ত ও দোজখ। ইহারা পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। যেহেতু হাশরের মাঠ হইতে যাত্রা করিয়া দোজখে যাওয়া যায় এবং পোলছিরাত পার হইয়া বেহেস্তেও যাওয়া যায়। পৃথিবীতে ইহার একটি রূপক ব্যবহার করা যাইতে পারে। মনে করা যা’ক — আরব সাগর একটি অগ্নিসমুদ্র (দোজখ)। ইহার উপর দিয়া বোম্বাই হইতে এডেন পর্যন্ত একটি পুল আছে। এখন ভারতবর্ষ যদি হয় হাশরের মাঠ তাহা হইলে আরবদেশ হয় বেহেস্ত। অবস্থানটা এইরূপ নয় কি?
সে যাহা হউক, পরজগত যে কোন এক সৌরজগতের অধীন, তাহার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় হাশর মাঠের প্রাকৃতিক বর্ণনায়। কথিত হয় যে, হাশর ময়দানে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে পাপীদের মস্তিষ্ক বিগলিত হইবে এবং বেহেস্তে সুস্নিগ্ধ বায়ু প্রবাহিত হইবে। ইহাতে মনে হয় যে, হাশরের মাঠ ও দোজখ, সেখানের বিষুবীয় অঞ্চলে হইবে এবং বেহেস্ত হইবে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত।
পরজগতের আয়তন ইহজগতের তুলনায় কতগুণ বড় বা ছোট এবং হাশর মাঠের সীমা-চৌহদ্দি কি তাহা জানি না। তবে বেহেস্ত, দোজখ সীমিত। যেহেতু সংখ্যায় বেহেস্ত ৮টি এবং দোজখ ৭টি। যাহা সংখ্যা দ্বারা সূচিত হয়, তাহা সসীম হইতে বাধ্য। কেননা এক একটি বেহেস্ত বা দোজখ আয়তনে যত বিশালই হউক না কেন, একটির শেষ সীমা নির্ধারিত না হইলে আর একটির অবস্থান অসম্ভব কাজেই যে কোন একটির সীমা নির্ধারিত হইলে সব কয়টির সীমা যে নির্দিষ্ট, তাহা অনিবার্য। তাই প্রশ্ন হইতেছে যে, বেহেস্ত, দোজখ এবং হাশর মাঠের বর্হিভাগে কোন দেশ থাকিবে কি? থাকিলে সে দেশে কোন বাসিন্দা থাকিবে কি না?
শোনা যায় যে, পরলোকে সূর্য থাকিবে এবং সে উত্তাপ প্রদান করিবে। তবে কি আলো প্রদান করিবে না? যদি করে তাহা হইলে কি পরলোকেও দিনরাত্রি হইবে? যদি হয়, তবে তাহা কি রকম হইবে? অর্থাৎ সূর্য দৌড়াইবে, না ইহগজত বা পৃথিবীর মত পরজগতটা ঘুরিবে, না অনন্তকাল শুধু দিনই থাকিবে?
৬। ইহকাল ও পরকালে সাদৃশ্য কেন?
পরকালের অন্তর্গত কবর হাশর, বেহেস্ত, দোজখ ইত্যাদির যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায়, তার প্রত্যেকটি বর্ণনার বিষয়বস্তুই যেন এই পৃথিবীর বিষয়বস্তুর অনুকরণ বা সংস্করণ। যথা (কবরে) ছওয়াল বা প্রশ্ন, গুর্জ বা গদা, স্নিগ্ধ সমীরণ, উত্তপ্ত বায়ু প্রভৃতি; (হাশর ময়দানে) তামার পাত, সূর্যের তাপ, সাক্ষ্য জবানবন্দী, দাড়ি-পাল্লা, বিচার ইত্যাদি, (বেহেস্তে) সুমিষ্ট ও সুস্বাদু ফল, সুপেয় জল, দুধ, মধু, সুন্দরী রমণী ইত্যাদি এবং (দোজখে) অগ্নি, পুঁজ, রক্ত, গরম জল, পোল, সাঁড়াশী ইত্যাদি যাবতীয় পারলৌকিক বর্ণনা সমূহের আদ্যন্ত পর্যালোচনা করিলে মনে হয় যে, পরলোকের সবকিছুই যেন এই পৃথিবী হইতে গৃহীত, কিছুটা পরিবর্ধিত ও কিছুটা পরিবর্তিত। পরলোকে কি কিছুই অভিনব থাকিবে না?
৭। স্বর্গ-নরক কোথায়?
এক কবি বলিয়াছেন –
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেই সুরাসুর।
কবি কল্পিত ঐ স্বর্গ-নরক এই জগতেই। তবে উহা আধ্যাত্মিক, মানুষের মনোরাজ্যেই উহার অবস্থান। ইহা ভিন্ন পৃথিবীতে আর এক রকম স্বর্গের কথা শোনা যায়, উহা মানুষের শান্তির আবাস। হিন্দু শাস্ত্র আলোচনায় জানা যায় যে, স্বর্গ দেশটি দেব-দেবীগণের বাসস্থান। ওখানে চির বসন্ত বিরাজিত এবং শোক-তাপ, জরা-মৃত্যু কিছুই ওখানে নাই। ওখানে নন্দন কানন, পারিজাত বৃক্ষ, সুরভী গাভী, ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব প্রভৃতি সুখ সাধনের সামগ্রী সমস্তই বিদ্যমান আছে এবং স্বর্গবাসীদের কামনা-বাসনা মিটাইবার জন্য ওখানে অপ্সরা, কিন্নরী, গন্ধর্ব ইত্যাদি দেহবিলাসিনীও আছে।
উক্ত দেবপুরী বা স্বর্গদেশটি দুর্গম, দুরারোহ ও অতি উচ্চে অবস্থিত স্থান। হিন্দু মতে উহা সুমেরু পর্বতের উপরে অবস্থিত। বস্তুত উহা হিমালয় পর্বতের অংশ বিশেষ৬। অসাধারণ শারীরিক ও মানসিক শক্তি সম্পন্ন না হইলে এখানে কেহই পৌঁছিতে পারিত না। ওখান হইতে নীচু সমতল ভূমিকা বলা হইত ‘মর্ত্য’। সাধারণ মানুষ এই মর্ত্যলোকেই বাস করিত, শুধু দেবতারাই স্বর্গে ও মর্ত্যে যাতায়াত করিতে পারিতেন, সাধারণ মানুষ তাহা পারিত না।
মহাভারত পাঠে জানা যায়, যে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পদব্রজে সশরীরে স্বর্গে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁর স্বর্গ গমনের গতিপথ লক্ষ্য করিলে বুঝা যায় যে, ঐ স্বর্গটি কৈলাশপুরী ভিন্ন আর কোথায়ও নহে এবং হিমালয় পর্বতের একাংশে উহা অবস্থিত ছিল৭। ধর্মরাজ ওখানে পৌঁছিতে পারিয়াছিলেন, না পথেই মারা গিয়াছিলেন তাহা আমাদের জানা নাই। কিন্তু তৎপর বিখ্যাত পর্বতারোহী তেনজিং ও হিলারী বাদে বোধ হয় আর কোন মানুষ ওখানে যায় নাই।
মর্তবাসী মানুষের ওখানে যাতায়াত নাই বলিয়া দেবতারা ঐ স্বর্গে এখনও বাঁচিয়া আছেন, না মারা গিয়াছেন এবং ঐ স্বর্গটি আবাদী আছে, না জঙ্গলে পরিণত হইয়াছে — বর্তমানে তাহার কোন খবর নাই। ঐ স্বর্গটি বা স্বর্গীয় দেব-দেবীগণ বর্তমান থাকিলে ইদানীং পর্বতারোহীদের সামনে পড়িত।
রামায়ণ পাঠে জানা যায় যে, লঙ্কাধিপতি রাবণ মর্ত্য হইতে স্বর্গে আরোহণ করিয়া দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন এবং তাঁর পুত্র মেঘনাদ দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী করিয়া ‘ইন্দ্রজিৎ’ আখ্যা পাইয়াছিলেন। ইহাতে মনে হয় যে, যে কোন মর্ত্যবাসী গায়ের জোরেই ঐ স্বর্গে যাইতে পারিত। অতঃপর লঙ্কেশ্বর মর্ত্যবাসীগণ যাহাতে সহজে স্বর্গে উঠিতে পারে তাহার জন্য মর্ত্য হইতে স্বর্গ পর্যন্ত একটি সিঁড়ি তৈয়ার করিবার পরিকল্পনাও করিয়াছিলেন। কিন্তু রামের হাতে তাঁহার অকালমৃত্যু হওয়ায় উহা তিনি কার্যে পরিণত করিয়া যাইতে পারেন নাই। ইহাতে মনে হয় যে, রাবণরাজ দেবপুরী বা স্বর্গ অর্থাৎ হিমালয় পর্বতে আরোহণোপযোগী একটি সহজ পথ আবিষ্কারেরই পরিকল্পনা করিয়াছিলেন।
মুসলমানদের পুরান কাহিনী অনেক ক্ষেত্রে তৌরিত কেতাব তথা বাইবেলের অনুসারী। তবে কোন কোন স্থানে নামধামের সামান্য অদলবদল দেখা যায়। যেমন — ইভ = হাওয়া, সর্প = শয়তান, জ্ঞানবৃক্ষ = গন্ধম, এদন উদ্যান = বেহেস্ত ইত্যাদি।
তৌরিতে যে স্থানকে ‘এদন উদ্যান’ বলা ইহয়াছে, মুসলমানগণ ঐ স্থানকেই ‘বেহেস্ত’ এবং ঐ স্থানের ঘটনাবলীকেই বেহেস্তের ঘটনাবলী বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন।
হজরত আদমের আদিম বাসস্থান সম্বন্ধে তৌরিতের বিবরণটি এইরূপ — “আর সদাপ্রভু ঈশ্বর পূর্বদিকে এদনে এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন এবং সেই স্থানে আপনার নির্মিত ঐ মনুষ্যকে রাখিলেন। আর সদাপ্রভু ঈশ্বর ভূমি হইতে সর্ব জাতীয় সুদৃশ্য ও সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষ এবং সেই উদ্যানের মধ্যস্থানে ‘জীবন বৃক্ষ’ ও ‘সদসদজ্ঞানদায়ক বৃক্ষ’ উৎপন্ন করিলেন। আর উদ্যানে জলসেচনার্থে এদন হইতে এক নদী নির্গত হইল। উহা তথা হইতে বিভিন্ন হইয়া চতুর্মুখ হইল। প্রথম নদীর নাম পীশোন, ইহা সমস্ত হবিলাদেশ বেষ্টন করে, তথায় স্বর্ণ পাওয়া যায় আর সেই দেশের স্বর্ণ উত্তম। দ্বিতীয় নদীর নাম গীহোন, ইহা সমস্ত কুশদেশ বেষ্টন করে। তৃতীয় নদীর নাম হিদ্দেকল, ইহা অশূরিয়া দেশের সম্মুখ দিয়া প্রবাহিত হয়। চতুর্থ নদীর নাম ফরাৎ।”৮
তৌরিতের উক্ত বিবরণে দেখা যায় যে, পীশোন, গীহোন, হিদ্দেকল ও ফরাৎ এই নদী চারিটির উৎপত্তির এলাকার মধ্যে ঐ সময় ‘এদন’ নামে একটি জায়গা ছিল এবং ঐ এদনস্থিত একটি সুরম্য বাগানে আদমের বাসস্থান ছিল। ‘এদন’ জায়গাটি বোধ হয় যে, বর্তমান তুরস্ক দেশের পূর্বভাগে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তৌরিত গ্রন্থে লিখিত নদী চারিটি ঐ অঞ্চল হইতে উৎপন্ন হইয়া, পীশোন ও গীহোন নামক নদীদ্বয় কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে এবং হিদ্দেকল ও ফরাত নামক নদীদ্বয় একত্র হইয়া পারস্যোপসাগরে পতিত হইয়াছে। ঐ এদন উদ্যানে বাস করাকে বলা হয় ‘আদমের বেহেস্ত বাস’ এবং এদন উদ্যানকে বলা হয় ‘বেহেস্ত’।
বর্তমান কালের বহুল প্রচারিত ‘বেহেস্ত-দোজখ’ নাকি কোটি কোটি বৎসর পূর্বে সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত উহা ব্যবহার করা হয় নাই। শোনা যায় যে কেয়ামতের পর বিচারান্তে উহাতে লোক ভর্তি করা হইবে। আবার শোনা যায় যে, এস্রাফিল ফেরেস্তার সিঙ্গার ফুঁকে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড অর্থাৎ আল্লাহ্র যাবতীয় সৃষ্টিই লয় হইয়া যাইবে, স্বয়ং আল্লাহ ব্যতীত আর কিছুই থাকিবে না। তাহাই যদি হয় তবে বেহেস্ত-দোজখ লয় হইবে কিনা। যদি সঞ্চারের পূর্বেই উহা লয় হইয়া যায়, তবে কেয়ামতের পূর্বে আল্লাহ উহা সৃষ্টি করিলেন কেন, আর যদি না হয়, তবে উহা কি আল্লাহর সৃষ্টির বাহিরে অবস্থিত? অধিকন্তু কেয়ামতের পর বিচারান্তেই যদি উহাতে লোকভর্তি করা হয়, তবে এতাধিক কাল পূর্বে উহা সৃষ্টির সার্থকতা কি?
বহুপূর্বকালে পাশ্চাত্যের এক বড় শহরের নিকট একটি স্থানের নাম ছিল নাকি ‘গেহেন্না’। শহরের যাবতীয় ময়লা, রাশি রাশি আবর্জনা ও মৃত লাশ ওখানে ফেলিয়া জ্বালাইয়া দেওয়া হইত এবং অপরাধীগণকে ওখানে নিয়া নানারূপ শাস্তি দেওয়া হইত বা পোড়াইয়া মারা হইত। তৎকালীন লোকে ঐ জায়গাটাকে — নোংরা বলিয়া ঘৃণা ও বীভৎস বলিয়া অতিশয় ভয় করিত, কোন লোক ওখানে স্বেচ্ছায় যাইত না। বরং কোন ব্যক্তি কোনরূপ অসৎ কাজ করিলে লোকে তাহাকে এই বলিয়া শাসাইত যে, সে গেহেন্না যাইবে। অথবা বলিত “তুমি কি গেহেন্না যাইতে চাও?” ইত্যাদি।
উক্ত ‘গেহেন্না’ শব্দটি ভাষান্তরে — গেহেন্নাম জেহেন্নাম (ইংরেজী g অক্ষরটির ‘জ’ উচ্চারণ) এবং আরবী ভাষায় উহা হইয়াছে নাকি ‘জাহান্নাম’।
বৈদিক মতে, স্বর্গকে মনে করা হয় অতিউচ্চে বা ঊর্ধ্বে অবিস্থত স্থান। তাই স্বর্গের এক নাম “ঊর্ধ্বলোক”। আবার ক্বচিৎ ইহার বিপরীত মতও শোনা যায়। কোন কোন ধর্মযাজক বলেন যে, পুণ্যবানদের কবরের সঙ্গে বেহেস্তের এবং পাপীদের কবরের সঙ্গে দোজখের (সুরঙ্গপথে) যোগাযোগ হয়। ইহাতে মনে হয় যে, বেহেস্ত-দোজখ ভূগর্ভেই অবস্থিত আছে। বাস্তবিকই কি তাহাই?
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, ভূ-পৃষ্ঠের গড় উত্তাপ ২০০ সেন্টিগ্রেড বা ৬৮০ ফারেনহাইট এবং ৩০ মাইল নিম্নের তাপমাত্রা ১২০০০ সে. বা ২২০০০ ফা.। এই উত্তাপে অনায়াসে পাথরাদি গলিয়া যাইতে পারে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ও লাভাক্ষরণ সেখান হইতেই হইয়া থাকে। নিম্ন দিকে ক্রমশ উত্তাপ বৃদ্ধি পাইয়া কেন্দ্রের দিকে তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৬০০০০ সে.৯। ইহা সূর্যের বহিরাবরণের তাপের সমান। ইহাতে বুঝা যায় যে, ভূ-গর্ভে নরকাগ্নি থাকা অসম্ভব নহে। কিন্তু স্বর্গীয় উদ্যান সমূহ কোন্ জায়গায়?
স্বর্গ ও নরকের-আধ্যাত্মিক, পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক বিবরণ যাহাই হউক, বর্তমানে উহার যে কল্পচিত্র দেখানো হয়, তাহার কোনরূপ ভৌগোলিক সত্তা আছে কি?
টীকাসমূহ
৬. সরল বাংলা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্র, পৃষ্ঠা. ৮৭২
৭. সরল বাংলা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্র, পৃষ্ঠা. ২৫১
৮. আদিপুস্তক (তৌরীত), ২:৪, পৃষ্ঠা. ১৪
৯. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১০২
০৫.চতুর্থ প্রস্তাবঃ-
[ধর্ম বিষয়ক]
১। আল্লাহ মানুষকে পরিবর্তন না করিয়া ঝঞ্ঝাট পোহান কেন?
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি ইচ্ছা করিলে অসম্ভবও সম্ভব করিতে পারেন। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যদি ইহাই হয় যে, মানুষ তাঁহার এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহা হইলে তিনি সমস্ত মানবকে দিয়া তাঁহার উদ্দেশ্য পালন করাইতে পারেন না কি? পারিলে তাহা না করিয়া তিনি মানুষের দ্বারা হেদায়েতের ঝঞ্ঝাট পোহান কেন? ইহাতে কি তাঁহার আসল উদ্দেশ্যের ব্যাঘাত ঘটিতেছে না? হযরত ইব্রাহিম, মুসা, ও মোহাম্মদ (দ.)-কে কোন মানুষ হেদায়েত করে নাই, করিয়াছেন আল্লাহতায়ালা। কিন্তু নমরুদ, শাদ্দাদ, ফেরাউন, আবু জাহেল ইত্যাদি কাফেরদিগকে তিনি হেদায়েত করিলেন না কেন? তিনি স্বেচ্ছায় হেদায়েত করিলেন না, না, করিতে পারিলেন না?
২। ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়?
যদিও মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ, তবু কর্মফলে বিশ্বাস আছে বলিয়াই সে জগতের সকল রকম কাজকর্ম করিয়া যাইতেছে্ সমাজ ও রাষ্ট্র কর্মফলকে ভিত্তি করিয়াই গঠিত হইয়াছে এবং ‘কর্মফল আছে’ বলিয়াই উহারা টিকিয়া আছে। রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে শিক্ষা দিতেছে – কর্ম কর, ফল পাইবে। কিন্তু ধর্ম শিক্ষা দিতেছে ইহার বিপরীত। ধর্ম বলিতেছে – কর্ম করিয়া যাও, ফল অদৃষ্টে (তকদীরে) যাহা লিখিত আছে, তাহাই পাইবে। এক্ষেত্রে মানুষ কর্ম করিল বটে, কিন্তু ফল রহিল ভগবানের কাছে ভাগ্যলিপিতে নিবদ্ধ। মানুষ জানিল না যে, সে তাহার কাজের ফল পাইবে কি না। কর্মফলের নিশ্চয়তা থাকিলে সন্দিগ্ধ মনেও কাজ করা চলে। যেহেতু তাহাতে মানুষ ভাবিতে পারে যে, হয়ত সে তাহার কাজের ফল পাইতেও পারে। কিন্তু ধর্ম বলে – কর্ম যা কিছুই কর না কেন, ফল নির্ধারিত যাহা আছে, তাহাই পাইবে, একটুও এদিক ওদিক হইবে না। তাহই যদি হয়, অর্থাৎ কর্মের দ্বারা ভাগ্যলিপি পরিবর্তিত না হয়, তবে কর্ম করিয়া লাভ কি? বিশেষত মানুষের কৃত ‘কর্মের দ্বারা ফলোৎপন্ন’ না হইয়া যদি ঈশ্বরের নির্ধারিত ‘ফলের দ্বারা কর্মোৎপত্তি’ হয়, তবে ‘সৎ’ বা ‘অসৎ’ কাজের জন্য মানুষ দায়ী হইবে কেন? মনে করা যাক – কোন এক ব্যক্তির ভাগ্যলিপিতে লেখা আছে যে, সে ‘নারকী’। এখন সে নির্ধারিত ঐ ফলোৎপাদক কার্য, যথা – চুরি, ডাকাতি, নরহত্যা ইত্যাদি করিবে না কি? যদি করে, তবে তাহা সে কাহার ইচ্ছায় করে? নিজের ইচ্ছায়, না ভগবানের ইচ্ছায়? আর যদি সে কোন পাপ-কর্ম না করিয়া পুণ্য কর্মই করে, তবে তাহার ভাগ্যলিপির ‘নারকী’ শব্দটি কাটিয়া, স্বর্গবাসী এই শব্দটি লেখা হইবে কি? যদি না-ই হয়, তবে হেদায়েতের তম্বিটি কি লৌকিক? আর যদি হয়, তবে ভবিষ্যৎজান্তা ভগবান এই পরিবর্তনের সংবাদ পূর্বাহ্নে জানিয়া প্রথমবারেই অকাট্য তালিকা প্রস্তুত করেন নাই কেন?
ভাগ্যলিপি অপরিবর্তনীয় হইলে স্বয়ং ভগবানও উহা মানেন কি না। যদি না মানেন, তবে তিনি উহা লিখিয়াছিলেন কেন? আর যদি মানেন, তবে তিনি লিপি প্রস্তুতির সময় স্বাধীন হইলেও বর্তমানে স্বাধীন হন কিরূপে? ভগবানের বর্তমান কর্তব্য কি শুধু তালিকা দেখিয়া দেখিয়া জীবকুলকে দিয়ে কার্য করান? তাহাই যদি হয়, তবে বিশ্বস্রষ্টার আশু কর্তব্য কিছুই নাই?
৩। আদমের পাপ কি?
আলেমগণ বলিয়া থাকেন যে, আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য হইল এই যে, আল্লাহ তাঁহার দ্বারা পৃথিবী মানুষপূর্ণ করিবেন এবং শেষপয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (দ.)-এর দ্বারা ইসলাম প্রচার করাইবেন ইত্যাদি। এই সমস্ত পরিকল্পনাই নাকি ভাগ্যলিপির অন্তর্ভুক্ত। আদমকে বেহেস্তে রাখিয়া তাঁহাকে গন্দম খাইতে যে নিষেধ করা হইয়াছিল, সে নিষেধ কি খোদাতা’লার আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল? আদম গন্দম খাইয়া প্রকারান্তরে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ করিলেন। যে কাজ ভাগ্যলিপির অনুকূল এবং আল্লাহর ইচ্ছাকে পূর্ণ করে, তাহাতে পাপ কি? পক্ষান্তরে আদম যদি গন্দম না খাইতেন, তাহা হইলে মাহফুজের (লিপিফলকের) যাবতীয় লিপিই বরবাদ হইত না কি? অর্থাৎ পৃথিবীতে মানবসৃষ্টি, বেহেস্ত, দোযখ, হাশর ময়দান ইত্যাদির পরিকল্পনা সমস্তই মাঠে মারা যাইত না কি?
৪। শয়তান কি?
শয়তানের সহিত কোন মানুষের প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকিলেও তাহার নামটির সাথে যথেষ্ট পরিচয় আছে। ‘শয়তান’ – এই নামটি এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইতেছে যে, হাটে, মাঠে, কোর্ট-কাছারীতে, দোকান, স্কুল-কলেজ, ওয়াজের মাহফিল ইত্যাদির সবর্ত্র এবং নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, এমনকি অনেক হিন্দুও ‘শয়তান’ নামটি ব্যবহার করিয়া থাকেন। কেহ, কেহ, এমনও বলিয়া থাকেন যে, “ব্যাটা ভারী শয়তান”। ‘শয়তান’ কথাটির ধাতুগত অর্থ যাহাই হউক, উহাকে সমাজের যাবতীয় দুষ্কর্মের কারক হিসাবেই লোক ব্যবহার করিতেছে।
ধর্মাধ্যায়ীগণ বলিয়া থাকেন যে, শয়তান পূর্বে ছিল ‘মকরম’ বা ‘ইবলিস’ নামক বেহেস্তবাসী একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেস্তা এবং অতিরিক্ত মুসল্লি। মকরম সেখানে খোদাতালার হুকুমমত আদমকে সেজদা না করায় ‘শয়তান’ আখ্যা পাইয়া চিরকাল মানুষকে অসৎ কাজের প্ররোচনা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়া পৃথিবীতে আসে এবং সে অদ্যাবধি নানাবিধ উপায়ে অসৎ কাজে প্ররোচনা বা দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।
আদম ও বিবি হাওয়াকে দাগা দিয়াছিল শয়তান একা। কিন্তু আদমের বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শয়তানেও কি বংশবৃদ্ধি হইতেছে? না হইলে দাগাকাজ সুচারুরূপে চলে কি রকম?
কেহ কেহ বলেন যে, শয়তানেও বংশবৃদ্ধি হয় এবং উহা মানুষের চেয়ে দশগুণ বেশী। কারণ প্রতিগর্ভে সাধারণত মানুষ জন্মে একটি, আর শয়তান জন্মে দশটি করিয়া। তাহাদের নাম হয় যথাক্রমে – জ্বলিতন, ওয়াছিন, নফছ, আওয়াম, আফাফ, মকার, মহুদ, দাহেম, ওল-হান ও বার্ ইহারা ক্ষেত্রবিশেষে থাকিয়া বিশেষ বিশেষ দাগাকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। অধিকন্তু ইহাদের মানুষের মত মরণ নাই। কেয়ামতের দিন মানবজাতি যখন কায় পাইবে তখন ইহাদের মৃত্যু ঘটিবে।
জন্ম-মৃত্যুর ঠেকাঠুকিতেও বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ টিকিয়া আছে প্রায় তিনশ কোটি। আর মানুষের চেয়ে দশগুন বৃদ্ধি পাইয়া শয়তানের সংখ্যা কত? আদম হইতে আজ পর্যন্ত যত লোক জন্মিয়াছে তাহারা যদি সকলেই জীবিত থাকিত, তাহা হইলে লোকসংখ্যা যত হইত, বোধ হয় যে, কোন ভাষার সংখ্যা দ্বারা তাহা প্রকাশ করা যাইত না। পৃথিবীতে বর্তমানে শয়তানের সংখ্যা তাহারই দশগুণ বেশী নয় কি? ইহাতে মনে হয় যে, পৃথিবীর জলে, স্হলে ও বায়ুমন্ডলে শয়তান গিজগিজ করিতেছে এবং প্রতিটি মানুষের পিছনে লাখ লাখ শয়তান দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।
এত অসংখ্য শয়তান মানবসমাজকে পাপের পথে অহরহ প্ররোচিত করিতেছে, কিন্তু শয়তানের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাইলেও অসৎকাজের মাত্রা ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে না, বরং মানবিক জ্ঞান ও সভ্যতা বৃদ্ধিরর সাথে সাথে অসৎকাজের মাত্রা ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। এখনও দেখা যায় যে, শিক্ষিতের সংখ্যা ও শিক্ষায়তনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িতেছে বৈ কমিতেছে না। ন্যায়নিষ্ঠ সাধুপুরুষদের সংখ্যাও নগণ্য নহে। লন্ডন শহরে নাকি এমন দোকানও আছে, যেখানে বিক্রেতা নাই। অথচ ক্রেতাগণ উচিত মূল্য দিয়াই জিনিসপত্র ক্রয় করিতেছে। আবার কোন রকম হারান জিনিস প্রাপ্ত হইয়াও কেহ তাহা আত্মসাৎ করে না। বরং লন্ডন ট্রান্সপোর্ট লস্ট প্রপার্টি অফিসে উহা জমা দিয়া থাকে, সেখান হইতে জিনিসের মালিক তাহা ফেরত পাইয়া থাকে।১০ সেখানে কি শয়তান কম?
ধর্মপ্রচারকদের বর্ণনা শুনিয়া মনে হয় যে, ফেরেস্তাগণ সবাই নপুংসক। মকরমও তাহাই ছিল ‘লানত’ বা অভিশাপ প্রাপ্তির সময়ও মকরম একাই ছিল এবং নপুংসক ছিল। তৎপর তাহার বংশবৃদ্ধির জন্য লিঙ্গভেদ হইল কখন? শুধু ইহাই নহে, শয়তানের বংশবৃদ্ধি সত্য হইলে, প্রথমত তাহার ক্লীবত্ব ঘুচাইয়া পুংলিঙ্গ গঠনাস্তে একটি স্ত্রী-শয়তানেরও আবশ্যক ছিল। বাস্তবিক কি শয়তানেও স্ত্রী আছে/ আর না থাকিলে্ই বা তাহার বংশবৃদ্ধির উপায় কি?
‘শয়তানের দাগা’ বলিতে কি শুধু রোজা-নামাজের শৈথিল্যই বুঝায়, না চুরি, ডাকাতি, বদমায়েশী, নরহত্যা ইত্যাদিও বুঝায়? যদি যাবতীয় অসৎকার্য শয়তান কর্তৃকই অনুষ্ঠিত হয়, তবে জাতিভেদে অসৎ কাজের মাত্রাভেদ হয় কেন? অর্থাৎ, যে কোন দেশের সম্প্রদায়সমূহের জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধী বা কারাবাসীর সংখ্যা হওয়া উচিত। কিন্তু তাহা না হইয়া সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের মধ্যে কারাবাসীর সংখ্যাধিক্য কেন?
জীবজগতে দেখা যায় যে, মাংসাশীগণ উগ্রস্বভাববিশিষ্ট এবং নিরামিষাশীরা শান্ত। গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, হাঁস-মোরগ, কবুতর, ইত্যাদি প্রাণী মাংসাশী নহে, ইহারা শান্ত। অথচ ব্যাঘ্র, সিংহ, শৃগাল, কুকুর, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণীকূল মাংসাশী এবং উগ্রস্বভাববিশিষ্ট। এ কথাও স্বীকার্য যে, স্বভাবের উগ্রতায় নানা প্রকার অঘটন ঘটিয়া থাকে। ইহাও দেখা যায় যে, মানব সমাজের ভিতর যে জাতি অতিরিক্ত মাংসাশী, সেই জাতির মধ্যেই অতিরিক্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নরহত্যা অনুষ্ঠিত হয়। এই সকল গর্হিত কাজের উৎপাদক কি শয়তান, না মাংস আর উত্তেজক মসল্লা?
বলা যাইতে পারে যে, কোন কোন দেশের মানুষ মাংসাশী হইয়াও বেশ শান্ত-শিষ্ট ও সংযমী। ইহার কারণ এই নয় যে, সে দেশে শয়তানের উপদ্রব কম বা সে দেশের মাংসে উত্তেজনাশক্তি নাই। ইহার কারণ এই যে, এইরুপ কোন জাতি নিরক্ষাঞ্চলের অধিবাসী নহে। অধিকাংশই হিমাঞ্চলের বাসিন্দা। দেশের শীতকালই তাহাদের স্বভাবের উগ্রতা প্রশমিত করিয়া রাখে।
সুধীগণ বলেন যে, মানুষের মধ্যে ছয়টি আধ্যাতিক শত্রু আছে। উহারা ষড়রিপু নামে পরিচিত। যথা == কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। ইহাদের তাড়নায় মানুষ নানাবিধ অসৎকাজ করিয়া থাকে। যে কোন উপায়ে হউক, ইহাদিগকে দমন করিতে পরিলে মানুষ নিষ্পাপ হইতে পারে।
মানোবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সভ্যতার ঊষালোক পইবার পূর্বে আহার-বিহারে মানুষ ও ইতর জীবের মনোবৃত্তির বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সে সময়ের মানুষের মন ছিল কৃত্রিমতাহীন, সরল ও স্বাধীন। তখন মানুষ তাহার যে কোন ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে পারিত। তখন প্রবৃত্তিই ছিল মানুষের যথাসর্বস্ব। জ্ঞান উন্মেষের সাথে সাথে মানুষ প্রথম দলবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে শুরু করে। এই দল বা সমাজকে রক্ষা করিতে আবশ্যক হইল ত্যাগ ও সংযমের। আদিতে এই ত্যাগ ও সংযম ছিল স্বেচ্ছাধীন। ক্রমে যখন সভ্যতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, তখন তাহার দল বা সমাজের বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সংযমকে বাঁধিল নীতি ও নিয়মের শৃঙ্খলে। ইহাতে মানুষের সেই স্বাধিন প্রবৃত্তিগলিকে সু ও কু – এই দুইভাগে বিভক্ত করিয়া সু প্রবৃত্তিগুলিকে স্বাধীনই রাখা হইল, কিন্তু কু প্রবৃত্তিগুলিকে করা হইল কারারুদ্ধ। কারাবাসী কুপ্রবৃত্তিগুলিকে মনের অন্ধকার কারাকক্ষে ঘুমাইয়া রহিল। মনের যে অংশে সেই রুদ্ধপ্রবৃত্তি বাস করে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাহাকে বলা হয় অচেতন মন বা নির্জ্ঞান মন (Unconscious Mind)।
মানুষ তাহার জাতিগত জীবনের হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন অচেতন মন স্বরুপ মূলধন (উত্তরাধিকার সূত্রে) লইয়া প্রথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ যে সকল অশুভ কামনা সমাজের নীতি, ধর্মের বিধান ও রাষ্ট্রের শাসনের ভয়ে চরিতার্থ করিতে পারে না, তাহাও ক্রমে বিস্মৃতির অতুলগর্ভে ডুবিয়া গিয়া অচেতন মনে স্হান লয়। অচেতন মনে রুদ্ধপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলিকে যে শক্তি অবরুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহাকে কারারক্ষী (Censor) বলা হয়। কারাবন্দী কুপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলির সহিত মেলামেশা করিয়া তাহাদিগকে বিপথে চালিত করে। ইহা হইতে মানব সমাজের যত কিছু বিড়ম্বনা। মানুষের যাবতীয় অশুভচিন্তা ও অসৎকাজের উদ্যোক্তা এই অচেতন মন।
এতদ্বিষয পর্যালোচনা করিলে বুঝা যায় যে, যাবতীয় অসৎকাজের উদ্যোক্তা মানুষের অভ্যন্তরীণ রিপুসমূহ, বাহিরের কিছু নয়। তবে কি মানুষের কু-প্রবৃত্তিগুলিকেই শয়তান বলা হয়, না মানবদেহাতিরিক্ত স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট শয়তান-এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়?
৫। উপাসনার সময় নির্দিষ্ট কেন?
দেখা যায় যে, সকল ধর্মেই কোন কোন উপাসনার জন্য বিশেষ বিশেষ সময় নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ঐ সকল উপাসনা করিলে বিশ্বপতি কে উহা মন্জুর করিবেন না, তাহার কোন হেতু পাওয়া যায় না। ইসলামিক শাস্ত্রে প্রত্যেহ পাঁচবার নামাজের ব্যবস্হা আছে। এই পাঁচবার নামাজের প্রত্যেকবারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আদেশ আছে, আবার কোন কোন সময়ে নামাজ নিষেধ।
পৃথিবী আবর্তনের ফলে যে কোন স্হিরমুহূর্তে বিভিন্ন দ্রাঘিমার উপর বিভিন্ন সময় সূচিত হয় এবং প্রতি মুহূর্তেই কোন না কোন স্হানে নির্দেশিত উপাসনা চলিতে থাকে। অথচ সূর্য উদয়, সূর্য অস্ত এবং মধ্যাহ্নে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ (হারাম)। ইহার তাৎপর্য কি? এখানে যখন সূর্যোদয় হইয়াছে, তখন এখান হইতে পশ্চিমে কোনখানে সূর্যোদয় নাই এবং এস্হান হইতে পূর্বদিকে পুর্বেই সূর্যোদয় হইয়াছে। এখানে যখন নামাজ পড়া হারাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই অন্যত্র হারাম নহে। উদাহারণস্বরুপ বলা যাইতে পারে যে, বরিশালে যখন সূর্যোদয় হইতেছে, তখল কলিকাতায় হয় নাই এবং চট্টগ্রামে কিছু পূর্বেই সূর্যোদয় হইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ বরিশালে যখন নামাজ পড়া হারাম, তখন কলিকাতা বা চট্টগ্রামে হারাম নহে। তাহা হইলে নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা নিষিদ্ধ হওয়ার তাৎপর্য কিছু আছে কি?
নামাজের নিষিদ্ধ সময় সম্বন্ধে যে কথা, ওয়াক্ত সম্বন্ধে সেই একই কথা। পৃথিবীর কোনস্হানেই ওয়াক্ত নহে – এরুপ কোন স্হির মুহূর্ত আছে কি? যদি না থাকে, অর্থাৎ, প্রতি মুহূর্তেই যদি পৃথিবীর কোন না কোন স্হানে নামাজ পড়া চলিতে থাকে, তবে নামাজের সময় নির্ধারণের তাৎপর্য কি?
একসময় পৃথিবীকে স্হির ও সমতল মনে করা হইত। তাই পৃথিবীর সকল দেশে বা সকল জায়গায় একই রকম সময় সূচিত হইবে, বোধহয় যে এরূপ মনে করিয়া ঐসকল বিধি-নিষেধ প্রবর্তিত হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পৃথিবী গোল ও স্হিতিশীল।
পৃথিবীর গোলকহেতু যে কোন স্হানে বিশেষত সাগর বা মরূভূমিতে দাঁড়াইয়া দৃষ্টিপাত করিলে নিজেকে ভূ-পৃষ্ঠের কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভ্রম হয়। মনে হয় যে, এই কারণেই আরববাসীগণ পবিত্র মক্কা শহরকে পৃথিবীর (ভূ-পৃষ্ঠের) কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভাবিতেন এবং ওখানের সকাল-সন্ধাকেই ‘সকল দেশের সকাল-সন্ধা’ বলিয়া মনে করিতেন। এই ভ্রমাত্মক ধারণার ফলে যে সকল সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে, তাহার কিছু আলোচনা করা যাক।
মনে করা যাক – কোন ব্যক্তি বেলা দেড়টার সময় জোহর নামাজ আদায় করিয়া বিমান-যোগে প্রতি ঘন্টায় তিন হাজার মাইল বেগে চট্টগ্রাম হইতে পবিত্র মক্কা যাত্রা করিলেন। সেখানে পৌঁছিয়া তিনি দেখেন যে, ওখানে তখন দুপুর হয় নাই। ওয়াক্ত হইলে ঐ ব্যক্তির আর একবার জোহর নামাজ পড়িতে হইবে কি?
প্রতি ঘন্টায় ১০৪১২/৩ মাইল বেগে পশ্চিম দিকে বিমান চালাইলে (আপাতদৃষ্টিতে) সূর্যকে গতিহীন বলিয়া দেখা যাইবে। অর্থাৎ আরোহীর কাছে প্রাত:, সন্ধ্যা ও মধ্যাহ্ন কিছুই হইবে না; সূর্য যেন স্হিরভাবে একস্হানে দাঁড়াইয়া থাকিবে। এমতাবস্হায় আরোহীদের নামাজ ও রোজার উপায় কি?
পৃথিবীর শুধু বিষুব অঞ্চলেই বৎসরের কোন কোন সময় দিন ও রাত্রির পরিমাণ প্রায় সমান হয় না, ব্যবধান অল্প থাকে। কিন্তু উহা হইতে যতই উত্তর বা দক্ষিণে যাওয়া যায়, দিন ও রাত্রির সময়ের ব্যবধান ততই বাড়িতে থাকে। মেরু অঞ্চলের কোন কোন দেশের বৎসরের কোন কোন সময় দিন এত বড় হয় যে, ‘সন্ধা’ ও ‘ভোর’-এর মাঝখানে কোন রাত্রি নাই। সেখানে এশার নামাজের উপায় কি?
মেরু অঞ্চলে বৎসরে মাত্র একটি দিবা ও একটি রাত্রি হয় অর্থাৎ ছয় মাসকাল একাদিক্রমে থাকে দিন এবং ছয় মাসকাল রাত্রি। ওখানে বৎসরে হয়ত পাঁচবার (পাঁচ ওয়াক্ত) নামাজ পড়া যায়, কিন্তু একমাস রোজা রাখা যায় কি রকমে?
৬। নাপাক বস্তু কি আল্লাহর কাছেও নাপাক?
পৃথিবীর দ্রব্যাদির মধ্যে কতক দ্রব্য ধর্মীয় বিধানে নাপাক (অপবিত্র)। কিন্তু সে সকল কি আল্লাহর কাছেও নাপাক? যদি তাহাই হয়, তবে তাহা তিনি সৃষ্টি করিলেন কেন? আর যদি না হয়, তবে নাপাক অবস্হায় তাঁহার গুণগান করিলে তাহা তিনি অগ্রাহ্য করিবেন কেন? বলা হয় যে, আল্লাহ সর্বত্র বিদ্যমান। যদি তাহাই হয়, তবে নাপাক বস্তুর ভিতরে আল্লাহর অবস্হিতি নাই কি?
৭। উপাসনায় দিগনির্ণয় কেন?
সাকার উপাসকগণ তাঁহাদের আরাধ্য দেবতার দিকে মুখ করিয়া উপাসনা করিয়া থাকেন। যেমন কালী দেবীকে স্হাপন করা হয় দক্ষিণমুখী করিয়া এবং দুর্গাদেবীকে পশ্চিমমুখী। তাই পূজারীকে বসিতে হয় যথাক্রমে উত্তর ও পূর্বমুখী হইয়া। কিন্তু এই দিগনির্ণয় কেন, তাহা আমরা জানি না। বলা হইয়া থাকে যে, আল্লাহ নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। তাহাই যদি হয়, তবে নিরাকার উপাসনায় কেবলার আবশ্যক কি এবং হাত তুলিয়া মোনাজাত কেন? ইহাতে আল্লাহর দিগবিশেষে স্হিতির সংকেত হয় কি না!
৮। ফেরেস্তা কি?
আমরা শুনিয়া থাকি যে, আল্লাহ নিরাকার। কিন্তু নিরাকার মাত্রই আল্লাহ নহে। বিশ্বব্যাপী ইথার (Ether) নিরাকার। কিন্তু ইথারকে কেহ ঈশ্বর বলে না। কেননা আকারবিহীন হইলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং উহার মধ্যে পদার্থের গুণও পাওয়া যায়। বিশেষত ইথার নিরাকার হইলেও চেতনাবিহীন। পদার্থ যতই সূক্ষাতিসূক্ষ হউক না কেন, উহার অস্তিত্ব এবং স্হিতি আছে। এমন কোন পদার্থ জগতে পাওয়া যায় নাই, যাহার অস্তিত্ব যন্ত্র বা ইন্দ্রিয়ানুভুতির বাহিরে। শোনা যায় যে, ফেরেস্তা নামক এক জাতীয় জীব আছে এবং উহারা স্বর্গ-মর্ত্য সর্বত্র, এমনকি মানুষের সহচররুপেও বিচরণ করে। অথচ মানুষ উহাদের সন্ধান পায় না। উহারা কি কোন পদার্থের তৈয়ারী নয়? যদি হয়, তবে কোন অদৃশ্য বস্তুর দ্বারা তৈয়ারী? তাহা কিন ঈশ্বর হইতেও সূক্ষ? হইলে তাহা কি? আর যদি কোন পদার্থের তৈয়ারী না হয়, তবে কি তাহারা নিরাকার?
আল্লাহ নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম এক মহাশক্তি। পক্ষান্তরে নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম আর একটি সত্তাকে ফেরেস্তা বলিয়া স্বীকার করিলে আল্লাহ অতুলনীয় থাকেন কিরূপে?
কেহ কেহ বলেন যে, ফেরেস্তারা নূরের তৈয়ারী। নূর বলিতে সাধারণত বুঝা যায় যে, আলো বা রশ্মি। সাধারণ আলো অদৃশ্য নয়, উহা দৃশ্যমান পদার্থ। কিন্তু বিশ্বে এমন কতকগুলি বিশেষ আলো বা রশ্মি আছে, যাহা চক্ষে দেখা যায় না। যেমন – আলফা রশ্মি, কসমিক রশ্মি ইত্যাদি। বিজ্ঞানীগণ নানা কৌশলে ইহাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন এবং ইহাদের গুণাগুণও প্রমাণ করিতে সক্ষম হইয়াছেন্ কিন্তু বিজ্ঞানীগণ উহার কোন রকম রশ্মির দ্বারা তৈয়ারী ফেরেস্তার সন্ধান পাইতেছেন না। ফেরেস্তারা কোন জাতীয় রশ্মির (নূরের) দ্বারা তৈয়ারী?
৯। ফেরেস্তার কাজ কি?
পবিত্র কোরান ও বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনায় জানা যায় যে, স্বয়ং খোদাতা’লার হুকুমে সব সৃষ্টি হইয়া গেল। সৃষ্টিকার্য সম্পাদনে আল্লাহ কোন ফেরেস্তার সাহায্য লন নাই। যিনি সৃষ্টি করিতে পারেন, তিনি তাহা রক্ষা বা পরিচালনাও করিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বসংসারের নানাবিধ কার্য সম্পাদন করিবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বও খোদাতা’লা অসংখ্য ফেরেস্তা সৃষ্টি করিলেন কেন? শোনা যায় যে, ফেরেস্তাগণের নিজ ইচ্ছামত কাজ করিবার ক্ষমতা নাই। যদিও বিভিন্ন কাজ করিবার জন্য বিভিন্ন ফেরেস্তা নিযুক্ত আছেন তথাপি তাঁহার আল্লাহর আদেশ ভিন্ন কোন কাজই করিতে পারেন না। বিশ্বর যাবতীয় কার্য নির্বাহের জন্য প্রত্যেক ফেরেস্তাকেই যদি আল্লাহর হুকুম দিতে হয়, তবে তাঁহার ব্যস্ততা কমিল কি? কথিত হয় যে, অসংখ্য ফেরেস্তার মধ্যে প্রধান ফেরেস্তা চারিজন। যথা – জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ও আজ্রাইল। ইহাদের কার্যাবলী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।
ক. জিব্রাইলঃ-
– এই ফেরেস্তা নাকি পয়গম্বরের নিকট খোদাতালার আদেশ পৌঁছাইতেন। হজরত মোহাম্মদ (দ.) দুনিয়ার শেষ পয়গম্বর। তাঁহার বাদে নাকি আর কোন নবী জন্মিবেন না। কাজেই জেব্রাইল ফেরেস্তাও আর দুনিয়ায় আসিবেন না। তবে কেন কেহ কেহ বলেন যে, নির্দিষ্ট কয়েকবার আসিবেন। সে যাহা হউক, জেব্রাইল ফেরেস্তা বর্তমানে কোন কাজ করেন কি? মনো বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, জেব্রাইল সম্মোহন বিদ্যা (Hyptonism) আয়ত্ত করিতে পারিলে তাহার দুরদুরান্তে অবস্হিত কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে মানসিক ভাবের আদান-প্রদান করা যায়। উহাকে (Telepathy) বলে। সর্বশক্তিমান খোদাতালা এই টেলিপ্যাথির নিয়মে নবীদের সাথে নিজেই কথাবার্তা বলিতে পারিতেন। কিন্তু তাহা না করিয়া তিনি ফেরেস্তা সৃষ্টি করিয়া তাঁহার মারফত নবীদের কাছে আদেশ পাঠাইয়াছেন কেন?
খ. মেকাইলঃ-
– শোনা যায়, মেকাইল ফেরেস্তা নাকি মানুষের রেজেক বা খাদ্য বন্টন করেন। ‘খাদ্যবন্টন’ বলিতে সাধারণ মানুষের খাদ্যই বোঝায়। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী যথা – পশু, পাখী, কীট-পতঙ্গ ও বিভিন্ন জাতীয় জীবাণুদের খাদ্যবন্টন করেন কে, অর্থাৎ মেকাইল ফেরেস্তা না স্বয়ং খোদাতালা? অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্যবন্টন যদি স্বয়ং খোদাতালাই করেন, তবে মানুষের খাদ্যবন্টন তিনি করেন না কেন? আর যদি যাবতীয় জীবের খাদ্যই মেকাইল বন্টন করেন, তবে জগতের অন্য কোন প্রাণীকে নীরোগ দেহে শুধু উপবাসে মরিতে দেখা যায় না, অথচ মানুষ উপবাসে মরে কেন? আর মেকাইল ফেরেস্তা যদি শুধু মানুষের খাদ্যবন্টন করেন তবে মানুষের মধ্যে খাদ্যবন্টনে এতোধিক পার্থক্য কেন? হয়ত কেহ নিয়মিত পক্ষামৃত (দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, মধু, চিনি) আহার করেন, অন্যত্র কেহ জলভাতে শুধু লবণ ও লঙ্কাপোড়া পায় না। মেকাইলের এই পক্ষপাতিত্ব কেন? মেকাইল ফেরেস্তা নাকি বিশ্বপতির আবহাওয়া বিভাগও পরিচালনা করেন। কিন্তু এই বিভাগেও তাঁহার যোগ্যতা বা নিরপেক্ষতার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে না। অতীতকালে যাহাই হইয়া থাকুক না কেন, বর্তমানে ব্যাপকভাবেই পৃথিবীতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়াছে এবং বিভিন্ন দেশের নেতাগণ তাঁহাদের নিজ নিজ দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত পতিত জমি আবাদ কর্মে মনোযোগ দিয়াছেন। কিন্তু সসীম ক্ষমতার জন্য সকল ক্ষেত্রে কার্যকৃত হইতে পারিতেছেন না। অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন মেকাইল ফেরেস্তার অসাধ্য কিছুই নই। পৃথিবীর উত্তরও দক্ষিণ মেরুদেশের সঙ্গে যদি সাহারা মরুপ্রদেশের তাপ বিনিময় করিয় যথারীতি বৃষ্টিপাত ঘটান যাইত, তাহা হইলে লক্ষ লক্ষ একর জমি চাষাবাদ ও ফসল উৎপাদনের যোগ্য হইত এবং তাহাতে দুনিয়ার খাদ্যসংকট কতকাংশে কমিয়া যাইত। মেকাইল ফেরেস্তা উহা করিতে পারেন কি না? যদি পারেন, তবে উহা তিনি করেন না কেন/
শোনা যায়, আরবদেশ বিশেষত মক্কা শহর নাকি খোদাতালার খুব প্রিয় স্হান। কেননা দুনিয়ার প্রায় যাবতীয় পয়গম্বর আরব দেশেই জন্মিয়াছিলেন এবং শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (দ.) পবিত্র মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই আরবদেশে বৃষ্টিপাত ও চাষাবাদ নাই বলিলেই চলে। কিন্তু খোদাতালার অপ্রিয় দেশ ভারতবর্ষে বিশেষত আসামের চেরাপুন্জিতে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় কেন?
ভারত-বাংলার কথাই ধরা যাক। কাশী হিন্দু জাতির একটি তীর্থস্হান ও নানাবিধ দেবদেবীর প্রতিমার জাদঘর এবং চট্টগ্রামে মুসলিম বারো আওলিয়ার দরগাহ। এই কাশীর উপর না হইয়া চট্টগ্রামের উপর এতোধিক ঝড়-বন্যা হয় কেন? দেখা যায় যে, পৃতিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে তাপ, বায়ুপ্রবাহ, মেঘ-বৃষ্টির অত্যধিক পরিমাণে বৈষম্য আছে। ইহার কারণ কি ঐ সকল অঞ্চল ও তাহার নিকটবর্তী সাগর-পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্হান, না মেকাইলের পক্ষপাতিত্ব?
গ. এস্রাফিলঃ-
– এই ফেরেস্তা নাকি শিঙ্গা (বাঁশী) হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। খোদাতালার হুকুমে যখন ঐ শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন, তখনই মহাপ্রলয় (কেয়ামত) হইবে এবং পুন: যখন খোদাতালার হুকুমে ফুঁক দিবেন, তখন হাশর ময়দানাদি পুন: সৃষ্টি হইবে। আদিতে খোদাহালার হুকুমেই যদি বিশ্ব-সৃষ্ট হইতে পারিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার হুকুমে ধ্বংস হইতে পারিবে না কেন? যদি পারে, তবে এস্রাফিলের শিঙ্গা ফুঁকিবার আবশ্যক কি? আবার – প্রথমবারে বিশ্বসৃষ্টি খোদাতালার হুকুমে হইতে পারিল, কিন্তু মহাপ্রলয়ের পরে পুন: হাশর ময়দানাদি সৃষ্টির জন্য শিঙ্গার ফুঁক লাগিবে কেন?
শোনা যায় যে, অনন্ত অতীতকাল হইতে এস্রাফিল ফেরেস্তা শিঙ্গা হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন এবং শেষ দিন (কেয়ামত) পর্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিবেন। অথচ এত অধিককাল দাঁড়াইয়া থাকিয় শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন মাত্র দুইটি। কেয়ামতের নির্দিষ্ট তারিখটি আল্লাহ জানেন না কি? জানিলে এস্রাফিল ফেরেস্তাকে এতকাল পূর্বে শিক্ষা হাতে দিয়া দাঁড় করিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি?
ঘ. আজ্রাইলঃ-
– যমদূত জীবের জীবন হরণ করেন, এই কথাটি হিন্দুদের বেদে বর্ণিত আছে এবং উহারই ধর্মান্তরে নামান্তর ‘আজ্রাইল ফেরেম্তা’। আজ্রাইল ফেরেম্তা যে মানুষর জীবন হরণ করেন, তাহার পরিষ্কার ব্যাখ্যা শোনা যায ধর্মপ্রচারকদের কাছে। কিন্তু উহাতে মৃত্যু সম্পর্কে অনেক প্রশ্নই অজ্ঞাত থাকিয়া যায়। গরু, ঘোড়া, বাঘ, মহিষাদি, পশু, কাক, শকুনাদী, পাখি, হাঙ্গর-কুমিরাদী জলজ জীব ও কীট-পতঙ্গাদির জীবণ হরণ করাও কি আজ্রাইলের কাজ? নানাজাতীয় জীবদেহের ভিতরে ও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এত অধিক ক্ষুদ্র জীবাণু বাস করে যে, তাহার সংখ্যা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন। বিশেষত ঐ সকল জীবের পরমায়ুও খুব বেশী নয়, কয়েক মাস হইতে কয়েক ঘন্টা বা মিনিট পর্যন্ত। উহাদের জীবনও কি আজ্রাইল হরণ করেন? আম, জাম, তাল, নারিকেলাদি উদ্ভিদের জন্ম-মৃত্যু আছে বলিয়া লোকে বহুকাল পূর্ব হইতেই জানিত। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ বলেন যে, শুধু তাহাই নহে, উদ্ভিদের ক্ষুধা, পিপাসা, সুখ-দু:খ, স্পর্শানুভূতি, এমনকি শ্রবণশক্তিও আছে। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয় যন্ত্র দ্বারা প্রমাণ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, গাছের নিকট গান-বাজনা হইলে উহাদের মন প্রফুল্ল হয়। সুতরাং উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবের জীবন-এ কোন পার্থক্য নাই। এই গাছের জীবন হরণ করেন কে? ইহা ভিন্ন অতিক্ষুদ্র এক জাতীয় উদ্ভিদ আছে, উহাকে বীজাণু বলা হয়। ইহারা অতিশয় ক্ষুদ্র বলিয়া খালি চোখে দেখা যায় না। ইহারা বায়ুমন্ডলে ভাসিয়া বেড়ায় এবং উপযুক্ত পরিবেশ পাইলে নানারুপে আত্ম প্রকাশ করে। যেমন শেওলা, বাইছা, ব্যাঙের ছাতা, সিঁধুল ইত্যাদি। ইহাদের জন্ম এবং মৃত্যু আছে। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?
এমন অনেক জাতের জীবাণু বা বীজাণু আছে যাহার জীবদেহে বিশেষত মানুষের দেহে প্রবেশ করিয়া নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে। উহাদের আকার এত ক্ষুদ্র যে, রোগীর দেহের প্রতি ফোঁটা রক্তে লক্ষ লক্ষ জীবাণু ও বীজাণু থাকে এবং যথাযোগ্য ঔষধ প্রয়োগে অল্প সময়ের মধ্যেই উহারা মারা যায়। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?
মানুষা ভিন্ন অন্যান্য যাবতীয় জীবের জীবনে যদি আল্লাহতালার আদেশেই উড়িয়া যায়, তবে মানুষের জন্য যমদূত কেন? আর বিশ্বজীবের যাবতীয জীবন যদি আজ্রাইল একাই হরণ করেন, তবে তাঁহার সময় সংকুলান হয় কিরুপে? আজ্রাইলের কি বংশবৃদ্ধি হয়? অথবা আজ্রাইলের সহকারী (Assistant) আজ্রাইল আছে কি? থাকিলে – তাহার কি এককালীন সৃষ্টি হইয়াছে, না জগতে জীববৃদ্ধির সাথে সাথে নূতন-নূতন আজ্রাইল সৃষ্টি হইতেছে?
সর্বশেষ প্রশ্ন এই যে, যমদূতই যদি জীবনের হরণ করেন, তবে ‘কারণে মরণ’ হয় কেন? অর্থাৎ রোগ, দুর্ঘটনা ইত্যাদি কোন কারণ ব্যতীত জীবের মৃত্যু হয় না কেন?
প্রকাশ আছে যে, আলোচ্য ফেরেস্তা চতুষ্টয় ভিন্ন আরও চারিজন ফেরেস্তা আছেন, যাঁহারা প্রত্যেক মানুষের সহিত সংশ্লিষ্ট। উহারা হইলেন – কোরামান ও কাতেবীন এবং মনকির ও নকিন। উহাদের সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাইতেছে।
ঙ. কোরমান ও কাতেবীনঃ-
– ধর্মযাজকগণ বলিযা থাকেন যে, মানুষের সৎ ও অসৎ কাজের বিবরণ লিখিয়া রাখিবার জন্য প্রত্যেক মানুষের কাঁধের উপর কোরমান ও কাতেবীন নামক দুইজন ফেরেস্তা বসিয়া আছেন। উহাদের একজন লেখেন সৎকাজের বিবরণ এবং অপরজন অসৎ কাজের বিবরণ। এই ফেরেস্তাদ্বয়ের লিখিত বিবরণ দেখিয়া মানুষের পাপ ও পুণ্যের বিচার হইবে। মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াই কোন শিশু পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয় না। কেননা তখন তাহাদের ন্যায় বা অন্যায়ের কোন জ্ঞান থাকে না। বলা হইয়া থাকে যে, নাবালকত্ব উত্তীর্ন না হওয়া পর্যন্ত কোন মানুষের উপর নামাজ ও রোজা ফরজ হয় না।
মানুষ সাবালক হইবার নির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। শৈশব উত্তীর্ণ হইয়া কৈশোরে পদার্পণ ও কৈশোর পার হইয়া যৌবনে পদাপর্ণ, ইহার কোনটিই একদিনে হয় না। মানুষ সাবালক হইবার বয়স – কেহ বলেন ১২ বৎসর, কেহ বলেন নারীর ১৪ ও পুরুষের ১৮ বৎসর ইত্যাদি। এমতাবস্হায় কেরামান ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় কাঁধে আসেন কোনসময়? শিশু ভূমিষ্ঠ হইবার পরমুহূর্তে না সাবালক হইবার পর? শিশুর জন্মমুহূর্তের পর হইতে আসিলে ফেরেস্তাদের বেশ কয়েক বৎসর কর্মহীন অবস্হায় বসিয়া দিন কাটাইতে হয়। পক্ষান্তরে মানুষ সাবালক হইবার সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। ঐ বিষয়ে ঈশ্বরানুমোদিত সার্বজনীন কোন তারিখ আছে কি?
শোনা যায় যে, ফেরেস্তারা নাশাক ও দুর্গন্ধময় স্হানে থাকেন না বা উহা পছন্দ করেন না। তাই ফেরেস্তাদের মনোরন্জনের জন্য কেহ কেহ পাক সাফ থাকেন ও খোশবু ব্যবহার করেন। ধর্মীয় মতে অমুসলমান মাত্রই নাপাক। যেহেতু উহারা যথারীতি ওজু গোসল করে না, হারাম দ্রব্য ভক্ষণ করে, এমনকি কেহ কেহ মলত্যাগ করিয়া জলশৌচও কর না। আবার ডোম, মেথর ইত্যাদি অস্পৃশ্য জাতি নাপাক ও দুর্গন্ধেই ডুবিয়া থাকে। উহাদের কাঁধে ফেরেস্তা থাকেন কি না?
যে কোন মানুষের মৃত্যুর পর তাহার কাঁধের ফেরেস্তাদের কার্যকাল শেষ হইয়া যা। অত:পর তাঁহারা কি করেন? অর্থাৎ, কোন ঊর্ধ্বতন ফেরেস্তা বা আল্লাহতালার নিকট তাঁহার নথিপত্র বুঝাইয়া দিয়া অবসর জীবন যাপন করেন, না নিজ জিম্মায় কাগজপত্র রাখিয়া উহার হেফাজতে দিন কাটান, না অন্য কোন মানুষের কাঁধে বসিয়া কাজ শুরু করেন?
শোনা যায় যে, ফেরেস্তাদের নির্দিষ্ট সংখ্যা নাই এবং থাকিলেও তাহা আল্লাহ ব্যতীত আর কেহ জানে না। উহাদের মধ্য হইতে শুধুমাত্র কেরামন ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় ব্যতীত আর কোন ফেরেস্তার সহিত মানুষের ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা নাই। বাকিদের মধ্যে মাত্র আজ্রাইল ফেরেস্তা কাছে আসেন একদিন, তাহা অন্তিমকালে এবং মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মানুষের চির সহচর। হাঁটিতে, বসিতে, ভোজনে, শয়নে সবসময়ই উহারা মানুষের পার্শ্বচর। বিশেষত উহাদের অবস্হান মানুষের চক্ষু ও কর্ণ হইতে চারি-পাঁচ ইঞ্চির বেশী দূরে নয়। অথচ মানুষ উহাদের গতিবিধি দেখিতে, শুনিতে, অথবা অস্তিত্বকেই অনুভব করিতে পারে না। ইহার কারণ কি?
মানুষের কার্যবিবরণী ফেরেস্তাগণ যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, উহাতে কালি, কলম ও কাগজ বা অনুরূপ অন্য কিছু আবশ্যক। আলোচ্য বিবরণগুলি যদি বাস্তব হয়, তবে উহা লিখিবার উপকরণও হওয়া উচিত পার্থিব। অথচ মানুষ উহার কোন কিছুরই সন্ধান পায় না। উহার বাস্তবতার কোন প্রমাণ আছে কি? যদি না থাকে, তাহা হইলে – যখন ফেরেস্তারা অদৃশ্য, কালি অদৃশ্য, কলম এবং কাগজও অদৃশ্য, তখন বিবরণগুলি ঐরুপ নয় কি?
চ. মনকির ও নকিরঃ-
কথিত হয় যে, মানুষ কবরস্হ হইবার কিছুক্ষণ পরই ‘মনকির’ ও ‘নকির’ নামক দুইজন ফেরেস্তা আসিযা মৃতকে পুনর্জীবিত করেন ও তাহাকে ধর্ম-বিষয়ে কতিপয় প্রশ্ন করেন। সদুত্তর দিতে পারিলে তাহার সুখের অবধি থাকে না। কিন্তু তাহা না পারিলে তাহার উপর হয় নানারুপ শাস্তি। গুজের (গদার) আঘাতে ৭০ গজ মাটির নীচে প্রৌথিত হয়ে যায়, আবার ঐ ফেরেস্তার নখর দ্বারা তুলিয়া তাহাকে পুনরাঘাত করিতে থাকেন এবং সুড়ঙ্গপথে দোজখের আগুন আসিয়া পাপাত্মা মৃতকে জ্বালাইতে থাকে ইত্যাদি। কোন বিশেষ কারণ না থাকিলে সচরাচর মৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যেই কবরস্হ করা যায়। ঐ সময়ের মধ্যে মৃতদেহের মেদ, মজ্জা ও মাংসাদির বিশেষ কোন বিকৃতি ঘটে না। এই সময়ের মধ্যেই যদি সে পুনর্জীবন লাভ করিয়া সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়, তবে তাহার সেই নবজীবন হয় বিগত জীবনের অনুরূপ। কেননা দেখা যায় যে, সর্পঘাত, উগ্র মাদকদ্রব্য সেবন, ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ, কতিপয় রোগ, গভীর নিদ্রা ইত্যাদিতে মানুষের সংজ্ঞালোপ ঘটে। এইরুপ সংজ্ঞাহীনতা কয়েক ঘন্টা হইতে কয়েক দিন, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সপ্তাহকাল স্হায়ী হইতে দেখা যায়। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই সংজ্ঞাপ্রাপ্তির পর কাহারো পূর্বস্মৃতি লোপ পাইতে দেখা বা শোনা যায় নাই। কেননা মগজস্হিত কোষসমূহে (Cell) বিকৃতি না ঘটিলে কোন মানুষের স্মৃতি বা জ্ঞানের ভাবান্তর ঘটে না। তাই কাহারো ভাষারও পরিবর্তন ঘটে না।
হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক – দেহের এই তিনটি যন্ত্রের সুষ্ঠু ক্রিয়ার যৌথ ফলই হইল জীবনীশক্তি। উহার যে কোন একটা বা দুইটির ক্রিয়া সাময়িক লোপ পাওয়াকে ‘রোগ’ বলা হয়। কিন্তু ঐ তিনটির ক্রিয়া একযোগে লোপ পাওয়াকে বলা হয় মৃত্যু। শরীর বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, উক্ত যন্ত্রত্রয়ের একটি বা দুইটি নিষ্ক্রিয় (মৃত্যু) হইলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত তাহাও সক্রিয় করা সম্ভব হইবে। তাহাই যদি হয়, তবে কোন মৃত বাঙ্গালী পুনর্জীবিত হইলে সে কি ফরাসী ভাষায় কথা বলিবে, না, বাংলা ভাষায়?
পৃথিবীতে প্রায় ৩৪২৪টি বোধগম্য ভাষা আছে এবং অধিকাংশ মানুষই মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা জানে না। কাজেই কোন মৃতকে পুনর্জীবিত করা হইলে, অধিকাংশই তাহার মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় কথা বলিবার বা বুঝিবার সম্ভাবনা নাই। এমতাবস্হায় মনকিন ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মৃতকে প্রশ্ন করেন কোন ভাষায় – ফেরেস্তী ভাষায়, না মৃতের মাতৃভাষায়?
কেহ কেহ বলেন যে, হাশর ময়দানাদি পরলৌকিক জগতের আন্তর্জাতিক ভাষা হইবে আরবী, বোধহয় ফেরেস্তাদেরও। হাশর, ময়দানাদি পরজগতেও যদি পার্থিব দেহধারী মানুষ সৃষ্টি হয়, তবে তাহা হইবে এক অভিনব দেহ। কাজেই তাহাদের অভিনব ভাষার অধিকারী হওয়াও অসম্ভব নহে। কিন্তু মৃতের কবরস্হ দেহ অভিনব নয়, উহা ভূতপূর্ব। এক্ষেত্রে সে অভিনব (ফেরেস্তী বা আরবী) ভাষা বুঝিতে বা বলিতে পারে কিভাবে?
পক্ষান্তরে, যদি ফেরেস্তারা আঞ্চলিক ভাষায়ই প্রশ্ন করেন, তাহা হইলে ভিন্ন ভিন্ন ৩৬২৪ টি ভাষাভাষী ফেরেস্তা আবশ্যক। বাস্তবিক কি তাহাই?
ধর্মীয় বিবরণ মতে, পরলৌকিক ঘটনাবলীর প্রায় সমস্তই মানুষের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বাহিরে। কিন্তু ‘গোর আজাব’ – এই ঘটনাটি যদিও পরলোকের অন্তর্ভূক্ত, তথাপি উহার অবস্হান ইহলোকে অর্থাৎ এই পৃথিবীতেই। বিশেষত উহা মানুষের অবস্হান হইতে বেশী দূরেও নয়। বড় বড় শহরের গোরস্হানগুলি ছাড়া গ্রামাঞ্চলের কবরগুলি প্রায়ই থাকে বাসস্হানের কাছাকাছি এবং উহার গভীরতাও বেশী নয়, মাত্র ফুট তিনেকের মত। ওখানে বসিয়া ফেরেস্হা ও পুনর্জীবিত ব্যক্তির মধ্যে যে সকল কথাবার্তা, মারধোর, কান্নাকাটি ইত্যাদি কাহিনী হয়, অতি নিকটবর্তী মানুষও তাহা আদৌ শুনিতে পায় না কেন?
দেখা যাইতেছে যে, হত্যা সম্পর্কিত মামলাদিতে কোন কোন ক্ষেত্রে মৃতকে কবর দেওয়ার তিন-চারদিন বা সপ্তাহকাল পরে কবর হইতে তুলিয়া নেওয়া হয় এবং উহা অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ পরীক্ষা করিয়া থাকেন। কিন্তু যত বড় দুর্দান্ত ব্যক্তির লাশই হউক না কেন, কোন ডাক্তার উহার গায়ে গুর্জের আঘাতের দাগ বা আগুনে পোড়ার চিহ্ন পান নাই। অধিকন্তু খুব লক্ষ্য করিয়া দেখা গিয়েছে যে, মুর্দাকে যেইভাবে কবরে রাখা হয়েছিল, সেইভাবেই আছে, একচুলও নড়চড় হয় নাই। বিশেষত কবরের নিম্নদিকে ৭০ গজ গর্ত বা কোন পার্শ্বে (দোজখের সঙ্গে) সুড়ঙ্গ নাই। ইহার কারণ কি? গোর আজাবের কাহিনীগুলি কি বাস্তব, না অলীক?
এ কথা সত্য যে, কোন মানুষকে বধ করার চেয়ে প্রহার করা সহজ এবং সবল ব্যক্তির চাইতে দূর্বল ব্যক্তি বধ করা সহজ। রেল, জাহাজ, বিমান ইত্যাদির আকস্মিক দুর্ঘটনায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এক মুহূর্তে শত শত সুস্হ ও সবল মানুষ বধ করেন আজ্রাইল ফেরেস্তা একা। আর রুগ্ন, দুর্বল ও অনাহারক্লিষ্ট মাত্র একজন মানুষকে শুধু প্রহার করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তা কেন? পক্ষান্তরে শুধুমাত্র মৃতকে প্রশ্ন করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তার আবশ্যিকতা কিছু আছে কি?
জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ইত্যাদি নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম (Proper Noun)। কিন্তু কেরামন, কাতেবিন, মনকির ও নকির – এই নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম নয়, সম্প্রদায় বা শ্রেণীগত নাম (Common Noun)। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ জীবিত আছে।* তাহা হইলে সমস্ত মানুষের কাঁধে কেরামন আছে ৩০০ কোটি এবং কাতেবীন ৩০০ কোটি, জানিনা মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয়ের সংখ্যাও ঐরুপ কিনা। সে যাহা হউক, উহাদের ব্যক্তিগত কোন নাম আছে কি? না থাকিলে উহাদের কোন বিশেষ ফেরেস্তাকে আল্লাহ তলব দেন কি প্রকারে?
১০. দূরত্বহীন যাতায়াত কি সম্ভব?
শোনা যায় যে, স্বর্গীয় দূত জেব্রাইল আল্লাহর আদেশ মত নবীদের নিকট অহি (বাণী) লইয়া আসিতেন এবং তাহা নাজেল (অর্পণ) করিয়া চলিয়া যাইতেন। আসা ও যাওয়া – এই শব্দ দুইটি গতিবাচক এবং গতির আদি ও অন্তের মধ্যে দূরত্ব থাকিতে বাধ্য। আল্লাহতালা নিশ্চয়ই নবীদের হইতে দূরে ছিলেন না। তবে কি জেব্রাইলের আসা ও যাওয়া দূরত্বহীন? আর দূরত্ব থাকিলে তাহার পরিমাণ কত (মাইল)?
১১. মেরাজ কি সত্য, না স্বপ্ন?
শোনা যায় যে, হজরত মোহাম্মদ (দ.) রাত্রিকালে আল্লাহর প্রেরিত বোরাক নামক এক আশ্চর্য জানোয়ারে আরোহণ করিয়া আকাশভ্রমণে গিয়াছিলেন। ঐ ভ্রমণকে মেয়ারাজ বলা হয়। তিনি নাকি কোটি কোটি বৎসরের পথ অতিক্রম করিয়া আরশে পৌঁছিয়া আল্লাহর সহিত কথোপকথন করিয়াছিলেন এবং আল্লাহ তাঁহাকে ইসলামের দুইটি মহারত্ন নামাজ ও রোজা উপহার দিয়াছিলেন। ঐ রাত্রে তিনি বেহেস্ত-দোজখাদিও পরিদর্শন করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। ইহাতে নাকি তাঁহার সময় লাগিয়াছিল কয়েক মিনিট মাত্র। কথিত হয় যে, মেয়ারাজ গমনে হজরত (দ.)-এর বাহন ছিল – প্রথম পর্বে বোরাক ও দ্বিতীয় পর্বে রফরফ। উহারা এরুপ দুইটি বিশেষ জানোয়ার, যাহার দ্বিতীয়টি জগতে নাই। বোরাক – পশু, পাখী ও মানব এই তিন জাতীয় প্রাণীর মিশ্ররুপের জানোয়ার। অর্থাৎ তাহার ঘোড়ার দেহ, পাখীর মত পাখা এবং রমণীসদৃশ মুখমন্ডল। বোরাক কোন দেশ হইতে আসিয়াছিল, ভ্রমণান্তে কোথায় গেল, বর্তমানে কোথায়ও আছে, না মারা গিয়াছে, থাকিলে – উহার দ্বারা এখন কি কাজ করান হয়, তাহার কোন হদিস নাই। বিশেষত একমাত্র শবে মেয়ারাজ ছাড়া জগতে আর কোথাও ঐ নামটিরই অস্তিত্ব নাই। জানোয়ারটি কি বাস্তব না স্বপ্নিক?
হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন স্হাপত্যশিল্পের নিদর্শন পৃথিবীতে অনেক আছে। খৃ.পূ. তিন হাজার বৎসরেরও অধিককাল পূর্বে নির্মিত মিশরের পিরামিডসমুহ আজও অক্ষত দেহে দাঁড়াইয়া আছে। হজরতের মেয়ারাজ গমন খুব বেশীদিনে কথা নয়, মাত্র খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। ঘটনাটি বাস্তব হইলে – যে সকল দৃশ্য তিনি মহাশূণ্যে স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন (আরশ ও বেহেস্ত-দোজখাদি), তাহা আজও সেখানে বর্তনান থাকা উচিত। কিন্তু আছে কি? থাকিলে তাহা আকাশ-বিজ্ঞানীদের দূরবীনে ধরা পড়ে না কেন?
মেয়ারাজ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিতে হইলে প্রথম জানা আবশ্যক যে, হজরত (দ.) –এর মেয়ারাজ গমন কি পার্থিব না আধ্যাত্মিক; অর্থাৎ দৈহিক না মানসিক। যদি বলা হয় যে, উহা দৈহিক, তবে প্রশ্ন আসে – উহা সম্ভব হইল কিভাবে?
আকাশবিজ্ঞানীদের মতে – সূর্য ও গ্রহ-উপগ্রহরা যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে, তাহার নাম সৌরজগত, সূর্য ও কোটি কোটি নক্ষত্র মিলিয়া যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে তাহান নাম নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা এবং কোটি কোটি নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা মিলিয়া যে স্হান দখল করিয়া আছে, তাহার নাম নীহারিকাজগত।
বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, বিশ্বের যাবতীয় গতিশীল পদার্থের মধ্যে বিদ্যুৎ ও আলোর গতি সর্বাধিক। উহার সমতুল্য গতিবিশিষ্ট আর জগতে নাই। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল। আলো এই বেগে চলিয়া এক বৎসরে যতটুকু পথ অতিক্রম করিতে পারে, বিজ্ঞানীগণ তাহাকে বলেন এক আলোক বৎসর।
বিশ্বের দরবারে আমাদের এই পৃথিবী খুবই নগণ্য এবং সৌরজগতটিও নেহায়েত ছোট জায়গা। তথাপি এই সৌরজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে আলোক পৌঁছিতে সময় লাগে প্রায় ১১ ঘন্টা। অনুরূপভাবে, নক্ষত্রজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ৪০০০ কোটি আলোক বৎসর।১১ এই যে বিশাল স্হান, ইহাই আধুনিক বিজ্ঞানীদের পরিচিত দৃশ্যমান বিশ্ব। এই বিশ্বের ভিতরে বিজ্ঞানীরা বেহেস্ত, দোজখ বা আরশের সন্ধান পান নাই। হয়ত থাকিতে পারে ইহার বহির্ভাগে, অনন্ত দূরে। হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন যদি বাস্তব হয়, অর্থাৎ তিনি যদি সশরীরে একটি বাস্তব জানোয়ারে আরোহণ করিয়া সেই অনন্তদূরে যাইয়া থাকেন, তবে কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে আলোচ্য দূরত্ব অতিক্রম করা কিভাবে সম্ভব হইল? বোরাকে গতি সেকেন্ড কত মাইল ছিল?
বোরাকের নাকি পাখাও ছিল। তাই মনে হয় যে, সেও আকাশে (শূণ্যে) উড়িয়া গিয়াছিল। শূণ্যে উড়িতে হইলে বায়ু আবশ্যক। যেখানে বায়ু নাই, সেখানে কোন পাখী বা ব্যোমযান চলিতে পারে না। বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, প্রায় ১২০ মাইলের উপরে বায়ুর অস্তিত্ব নাই।১২ তাই তাঁহারা সেখানে কোনরুপে বিমান চালাইতে পারেন না, চালাইয়া থাকেন রকেট। বায়ুহীন মহাশূণ্যে বোরাক উড়িয়াছিল কিভাবে?
নানা বিষয় পর্যালোচন করিলে মনে হয় যে, হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন (আকাশভ্রমণ) সশরীরে বা বাস্তবে সম্ভব নহে। তবে কি উহা আধ্যাত্মিক বা স্বপ্ন?
এ কথায় প্রায় সকল ধর্মই একমত যে, ‘সৃষ্টিকর্তা সর্বত্র বিরাজিত’। তাহাই যদি হয়, তবে তাঁহার সান্নিধ্যলাভের জন্য দূরে যাইতে হইবে কেন? আল্লাহতালা ঐ সময় কি হযরত (দ.)-এর অন্তরে বা তাঁহার গৃহে, মক্কা শহরে অথবা পৃথিবীতেই ছিলেন না?
পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলিয়াছেন – তোমরা যেখানে থাক, তিনি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন।“ (সুরা হাদিদ – ৪)। মেয়ারাজ সত্য হইলে এই আয়াতের সহিত তাহার কোন সঙ্গতি থাকে কি?
১২. কতগুলি খাদ্য হারাম হইল কেন?
বিভিন্ন ধর্মমতে কোন কোন খাদ্য নিষিদ্ধ এবং কোন কোন দ্রব্য স্বাস্হ্য রক্ষার প্রতিকূল বলিয়া স্বাস্হ্যবিজ্ঞানমতেও ভক্ষণ নিষিদ্ধ। যে সকল দ্রব্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানি ঘটিতে পারে, তাহা নিষিদ্ধ হইলে বুঝা যায় যে, কেন উহা নিষিদ্ধ হইল। কিন্তু যে খাদ্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানির আশঙ্কা নাই, এমন খাদ্য নিষিদ্ধ (হারাম) হইল কেন?
১৩. এক নেকী কতটুকু?
স্হান, কাল, বস্তু ও বিভিন্ন শক্তি পরিমাপের বিভিন্ন মাপকাটি বা বাটখারা আছে। যথা – স্হান বা দূরত্বের মাপকাটি গজ, ফুট, ইঞ্চি, মিটার ইত্যাদি; সময় পরিমাপের ইউনিট ঘন্টা, মিনিট ইত্যাদি; ওজন পরিমাপের মণ, সের; বস্তু পরিমাপে গন্ডা, কাহন; তাপ পরিমাপে ডিগ্রি; আলো পরিমাপে ক্যান্ডেল পাওয়ার; বিদ্যুৎ পরিমাপে ভোল্ট, অ্যাম্পিয়ার ইত্যাদির ব্যবহার হয়। অর্থাৎ কোন কিছু পরিমাপ করিতে হইলেই একটি ইউনিট বা একক থাকা আবশ্যক। অন্যথায় পরিমাপ করাই অসম্ভব। কোন কোন ধর্মপ্রচারক বলিয়া থাকেন যে, অমুক কাজে ‘দশ নেকী’ বা অমুক কাজে ‘সত্তর নেকী’ পাওয়া যাইবে। এ স্হলে ‘এক নেকী’-এর পরিমাণ কতটুকু এবং পরিমাপের মাপকাটি কি?
১৪. পাপের কি ওজন আছে?
মানুষের মনের সুখ, দু:খ, ইচ্ছা, ঘৃণা, স্নেহ, হিংসা, দ্বেষ, অহঙ্কার ইত্যাদি কোন পদার্থ নহে, ইহারা মনের বিভিন্ন বৃত্তি মাত্র। ব্যক্তিভেদে এসবের তারতম্য লক্ষিত হয়। কাজেই বলিতে হয় যে, ইহাদেরও পরিমাণ আছে। কিন্তু পরিমাপক যন্ত্র নাই। কারণ ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাহিরে, সেই সমস্ত তৌলযন্ত্র বা নিক্তি দ্বারা মাপিবার চেষ্টা বৃথা। মনুষ্যকৃত ন্যায় ও ‘অন্যায়’ আছে এবং ইহারও তারতম্য আছে। কাজেই ইহারও পরিমাণ আছে। কিন্তু উহা পরিমাপ করিবার মত কোন যন্ত্র অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
‘অন্যায়’-এর পরিমাপক কোন যন্ত্র না থাকিলেও বিচারপতিগণ অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণকরত অন্যায়কারীকে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করিয়া থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিচারকগণ নান প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণপূর্বক অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেন, কোনরুপ যনত্র ব্যবহার না বা করিতে পারেন না।
কঠিন ও তরল পদার্থ ওজন করিবার জন্য নানা প্রকার তৌলযন্ত্র ও বাটখারা আছে। বর্তমান যুগে তৌলযন্ত্রের অভাবনীয় উন্নতি হইয়াছে। লন্ডন শহরের বৃটিশ ব্যাঙ্কে একটি তৌলযন্ত্র আছে। ভষারা (?? আমার বইয়ে পরিষ্কার নয়) নাকি একবারে একশত আশি মণ সোনা, রুপা বা অনুরুপ অন্যান্য দ্রব্যাদি ওজনে উহার কাঁটা দশ ইঞ্চি হেলিয়া পড়ে। তৌলযন্ত্রের এরুপ উন্নতি হইলেও – তাপ, আলো, কাল, দুরত্ব, বিদ্যুৎ ইত্যাদি উহা দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। যেহেতু ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। পূর্বেই বলিয়াছি যে, যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন শক্তির আওতার বাহিরে, তাহা তৌলযন্ত্র বা নিক্তি মাপিবার চেষ্টা বৃথা।
‘অন্যায়’-এর নামান্তর পাপ বা অন্যায় হইতেই পাপের উৎপত্তি। সে যাহা হউক, কোনরুপ তৌলযন্ত্র বা নিক্তি ব্যবহার করিয়া পাপের পরিমাণ ঠিক করা যা কিরূপে?
১৫. ইসলামের সাথে পৌত্তলিকতার সাদৃশ্য কেন?
আমরা শুনিয়া থাকি যে, সুসংস্কৃত ইসলামে কুসংস্কারের স্হান নাই। বিশেষত নিরাকার-উপাসক হইতে সাকার-উপাসকগণই অত্যধিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। যদিও বেদ বিশেষভাবে পুতুল-পূজা শিক্ষা দেয় নাই, তথাপি পরবর্তীকালে পুরাণের শিক্ষার ফলে বৈদিক ধর্ম ঘোর পৌত্তলিকতায় পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বৈদিক বা পৌত্তলিক ধর্মের সহিত ইসলাম ধর্মের অনেক সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়, যাহার ভাষা ও রুপগত পার্থক্য থাকিলেও ভাবগত পার্থক্য নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় বাদ দিলেও নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে উভয়ত সাদৃশ্য দেখা যায়। যথা –
১. ঈশ্বর এক – একমেবাদ্বিতীয়ম (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)।
২. বিশ্ব-জীবের আত্মাসমূহ এক সময়ের সৃষ্টি।
৩, মরণান্তে পরকাল এবং ইহকালের কর্মফল পরকালে ভোগ।
৪. পরকালের দুইটি বিভাগ – স্বর্গ ও নরক (বেহেস্ত-দোজখ)।
৫. স্বর্গ সাত ভাগে এবং নরক সাত ভাগে বিভক্ত। (কেহ কেহ বলেন যে, ইহা ভিন্ন আর একটি স্বর্গ আছে, উহা বাদশাহ শাদ্দাদের তৈয়ারী।)
৬. স্বর্গ বাগানময় এবং নরক অগ্নিময়।
৭. স্বর্গ উর্ধদিকে অবস্হিত।
৮. পুণ্যবানদের স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পাপীদের নরকবাস।
৯. যমদূত (আজ্রাইর ফেরেস্তা) কর্তৃক মানুষের জীবন হরণ।
১০. ভগবানের স্হায়ী আবাস ‘সিংহাসন’ (আরশ)।
১১. স্তব-স্তুতিতে ভগবান সন্তুষ্ট।
১২. মন্ত্র (কেরাত) দ্বারা উপাসনা করা।
১৩. মানুষ জাতির আদি পিতা একজন মানুষ – মনু (আদম)।
১৪. নরবলি হইতে পশুবলির প্রথা পচলন।
১৫. বলিদানে পুণ্যলাভ (কোরবাণী)।
১৬. ঈশ্বরের নাম উপবাসে পুণ্যলাভ (রোজা)।
১৭. তীর্থভ্রমণে পাপের ক্ষয় – কাশী-গয়া (মক্কা-মদিনা)।
১৮. ঈশ্বরের দূত আছে (ফেরেস্তা)।
১৯. জানু পাতিয়া উপাসনায় বসা।
২০. সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত (সেজদা)।
২১. করজোড়ে প্রার্থনা (মোনাজাত)।
২২. নিত্যউপাসনার নির্দিষ্ট স্হান – মন্দির (মসজিদ)।
২৩. মালা জপ (তসবিহ্ পাঠ)।
২৪. নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা করা – ত্রিসন্ধা (পাঁচ ওয়াক্ত)।
২৫. ধর্মগ্রন্হপাঠে পুণ্যলাভ।
২৬. কার্যারম্ভে ঈশ্বরের নামোচ্চরণ – নারায়ণৎ সমস্কতাং নবৈষ্ঞব নরোত্তমম (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম)।
২৭. গুরুর নিকট দীক্ষা (তাওয়াজ্জ)।
২৮. স্বর্গে গণিকা আছে – গন্ধর্ব, কিন্নরী, অপ্সরা (হুর-গেলমান)।
২৯. উপাসনার পুর্বে অঙ্গ ধৌত রা (অজু)।
৩০. দিগনির্ণয়পূর্বক উপাসনায় বসা বা দাঁড়ান।
৩১. পাপ-পুণ্য পরিমাপে তৌলযন্ত্র ব্যবহার (মিজান)।
৩২. স্বর্গস্বামীদের নদী পার হওয়া – বৈতরণী (পুলছিরাত) ইত্যাদি।
ঐ সমস্ত ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিধি-নিষেধেও অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়, সে সকল বিষয়ে চিন্তা করিলে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, হয়ত ইসলাম হইতে বিষয়গুলি পৌত্তলিকগণ গ্রহণ করিয়াছেন, নচেৎ পৌত্তলিকদের নিকট হইতে ইসলাম উহা গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে, পূর্ববর্তীগণের নিকট হইতে পরবর্তীগণ গ্রহণ করিয়াছে। পরবর্তী কাহারা?
টীকাসমূহ
১০. বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন, মু. আ. হাই, পৃষ্ঠা. ১৪১, ১৪২
১১. নক্ষত্র পরিচয়, প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা. ১৪, ১৬
১২. মহাকাশের ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ৯৫
* মূল পান্ডুলিপির রচনাকাল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ।
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1799#sthash.ofHt9bmo.dpuf
রচনাকাল ১১.৩.১৩৫৯ – ২০.৪.১৩৫৯
প্রকাশকাল [প্রথম সংস্করণ] কার্তিক ১৩৮০
প্রথম সংস্করণের ভূমিকাঃ-
এলোমেলোভাবে মনে যখন প্রশ্ন উদয় হইতেছিল, তখন তাহা লিখিয়া রাখিতেছিলাম, পুস্তক প্রণয়নের জন্য নহে, স্মরণার্থে। ওগুলি আমাকে ভাসাইতেছিল অকুল চিন্তা-সাগরে এবং আমি ভাসিয়া যইতেছিলাম ধর্মজগতের বাহিরে।
১৩৫৮ সালের ১২ই জৈষ্ঠ। বরিশালের তদানীন্তন ল-ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ও তবলিগ জামাতের আমির জনাব এফ. করিম. সাহেব আমাকে তাঁহার জামাতভূক্ত করার মানসে সদলে হঠাৎ তসরিফ নিলেন আমার বাড়ীতে। তিনি আমাকে তাঁহার জামাতভূক্তির অনুরোধ জানাইলে আমি তাঁহাকে বলিলাম যে ধর্মজগতে এরুপ কতগুলো নীতি, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি এবং ঘটনার বিবরণ প্রচলিত আছে, যাহা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নহে এবং ওগুলি দর্শন ও বিজ্ঞান এই তিনটি মতবাদের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে চিন্তা করিতে যাইয়া আমার মনে কতগুলি প্রশ্নের উদয় হইয়াছে এবং হইতেছে। আমি এগুলো সমাধানে অক্ষম হইয়া এক বিভ্রান্তির আঁধার কূপ হইতে উদ্ধার করিতে পারিলে আমি আপনার জামাতভূক্ত হইতে পারি। জনাব করিম সাহেব আমার প্রশ্নগুলি কি, তাহা জানিতে চাহিলে আমি আমার প্রশ্নের একখানা তালিকা (যাহা অত্র পুস্তকের ‘সূচীপত্র’ রুপে লিখিত আছে সেই রূপেই) তাঁহাকে প্রদান করিলাম। তিনি উহা পাঠ করিলেন এবং সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেলেন, আর বলিয়া গেলেন – “কিছুদিন বাদে এর জওয়াব পাবেন”।
করিম সাহেবকে প্রদত্ত তালিকার প্রশ্নের ব্যাখ্যা ছিল না। ফৌজদারী মামলার জবাবদিহি করিবার উদ্দেশ্যে আমাকে প্রশ্নগুলির কিছু ব্যাখ্যা লিখিতে হয়। সেই ব্যাখ্যা লিখাই হইল এই পুস্তক রচনার মূল উৎস। নির্দোষ প্রমাণে মামলা চূড়ান্ত হইলে ঐগুলিকে আমি পুস্তক আকারে গ্রন্হিত করিলাম। গ্রন্হনায় আমাকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা দান করিয়াছিল স্নেহাস্পদ মো. ইয়াছিন আলী সিকদার।
এই পুস্তকখানার সম্পাদনা সম্পর্কে নানাবিধ উপদেশ, ভ্রম সংশোধন, এলোমেলো প্রশ্নগুলিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শ্রেণীবিভাগ করিয়াছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেব।
এই পুস্তকখানার সম্পাদনা শেষ হইয়াছিল বিগত ১৩৫৮ সালে। কিন্তু নানা কারণে এযাবত প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই। বর্তমানে ইহার কোন কোন কালের অংশের কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিয়া প্রকাশ করা হইল। বর্ধিত অংশের ভ্রমাদি সংশোধনের শ্রম স্বীকার করিয়াছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মুহাম্মদ শামসুল হক সাহেব এবং প্রকাশনায় আর্থিক সাহায্যপ্রদান করিয়াছেন মাননীয় অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই সাহেব। এতদকারণে সহযোগীদের নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ।
বিনীত
গ্রন্হাকার
লামচরি, বরিশাল
২০ শ্রাবণ, ১৩৮০
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1793#sthash.7gGOun2L.dpuf
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকাঃ-
‘সত্যের সন্ধান’ পুস্তিকাখানা প্রকাশিত হইলে ইহা সুধীমহলে সমাদৃত হয়, বহু পত্র-পত্রিকায় প্রশংসামূলক সমালোচনা হইতে থাকে এবং বইখানার জন্য বাংলাদেশ লেখক শিবির আমাকে ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করে [৮.৫.১৯৭৯]।
আশা ছিল যে, ‘সত্যের সন্ধান’ পুস্তিকাখানার দ্বিতীয় মুদ্রণ সম্ভব হইলে তাহাতে কিছু নতুন তত্ত্ব জানার জন্য কিছু নতুন প্রশ্ন পরিবেশন করিব, কিন্তু নানা কারণে তাহা আর সম্ভব হইল না। এই বইখানা প্রথম প্রকাশের ব্যাপারে আমাকে যে সমস্ত প্রতিকূল অবস্হার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল এবং বর্তমানেও হইতেছে – আমি আশা করি যে, আমার লিখিত ‘মুক্তমন’ নামীয় পুস্তকখানার ‘ভূমিকা’-এ তাহা ব্যক্ত করিব। তবে সামান্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন যাহা করা হইল, তাহার মধ্যে ‘ঈশ্বর কি দয়াময়?’ শীর্ষক একটি প্রশ্ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) সরদার ফজলুল করিম সাহেবের লিখিত (সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত) একটি অভিমত ছাড়া আর কিছুই উল্লেখযোগ্য নহে। কালোপযোগী পরিবর্তন করা গেল না সময়ের অভাবে।
‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা প্রণয়নকালে ইহার একটি উপনাম দেওয়া হয়েছিল ‘যুক্তিবাদ’। কিন্তু বর্তমানে সুধীমহল এ পুস্তিকাখানাকে দর্শন শ্রেণীভূক্ত করায় ইহার উপনাম দেওয়া হইল লৌকিক দর্শন।
বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে এ পুস্তিকাখানার পুন:প্রকাশ আমার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হইত না – ঢাকাস্হ বর্ণমিছিল প্রেসের অধিকারী তাজুল ইসলাম সাহেবের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া। আমি তাঁহার নিকট শুধু কৃতজ্ঞই নহি, অপরিশোধ্য ঋণে ঋণী।
আরজ আলী মাতুব্বর
১৮ জৈষ্ঠ্য ১৩৯০
০১.মূলকথাঃ-
[প্রশ্নের কারণ]
অজানাকে জানার স্পৃহা মানুষের চিরন্তন। বাক্যস্ফুরণ আরম্ভ হইলেই শিশু প্রশ্ন করিতে থাকে এটা কি? ওটা কি? বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে, কলেজে ও কাজে-কর্মে অনুরূপ প্রশ্ন চলিতে থাকে এটা কি, ওটা কি, এরূপ কেন হইল, ওরূপ কেন হইল না ইত্যাদি। এই রকম ‘কি’ ও ‘কেন’র অনুসন্ধান করিতে করিতেই মানুষ আজ গড়িয়া তুলিয়াছে বিজ্ঞানের অটল সৌধ।
প্রশ্নকর্তা সকল সময়ই জানিতে চায় সত্য কি? তাই সত্যকে জানিতে পারিলে তাহার আর কোন প্রশ্নই থাকে না। কিন্তু কোন সময় কোন কারণে কোন বিষয়ের সত্যতায় সন্দেহ জাগিলে উহা সম্পর্কে পুনরায় প্রশ্ন উঠিতে থাকে।
কোন বিষয় বা কোন ঘটনা একাধিকরূপে সত্য হইতে পারে না। একটি ঘটনা যখন দুই রকম বর্ণিত হয়, তখন হয়ত উহার কোন একটি সত্য অপরটি মিথ্যা অথবা উভয়ই সমরূপ মিথ্যা; উভয়ই যুগপৎ সত্য হইতে পারে না হয়ত সত্য অজ্ঞাতই থাকিয়া যায়। একব্যক্তি যাহাকে “সোনা” বলিল অপর ব্যক্তি তাহাকে বলিল “পিতল”। এ ক্ষেত্রে বস্তুটি কি দুই রূপেই সত্য হইবে? কেহ বলিল যে অমুক ঘটনা ১৫ই বৈশাখ ১২টায় ঘটিয়াছে; আবার কেহ বলিল যে, উহা ১৬ই চৈত্র ৩টায়। এস্থলে উভয় বক্তাই কি সত্যবাদী? এমতাবস্থায় উহাদের কোন ব্যক্তির কথায়ই শ্রোতার বিশ্বাস জন্মিতে পারে না। হয়ত কোন একজন ব্যক্তি উহাদের একজনের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিল, অনুরূপ অন্য একব্যক্তি অপরজনের কথা সত্য বলিয়া স্বীকার করিল, অপরজন তাহা মিথ্যা বলিয়া ভাবিল। এইরূপে উহার সত্যাসত্য নিরূপণে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঘটিল মতানৈক্য। আর এইরূপ মতানৈক্য হেতু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঘটিয়া থাকে নানারূপ ঝগড়া-কলহ, বিবাদ-বিসম্বাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এই রকম বিষয় বিশেষ ব্যক্তিগত মতানৈক্যর ন্যায় সমাজ বা রাষ্ট্রগত মতানৈক্যও আবহমানকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে; যাহার পরিণতি সাম্প্রদায়িক কলহ ও যুদ্ধবিগ্রহরূপে আজ আমরা চোখের উপরই দেখিতে পাইতেছি।
জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যে সব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলে না। আবার ধর্মজগতেও মতানৈক্যের অন্ত নাই যেখানে একইকালে দুইটি মত সত্য হইতে পারে না, সেখানে শতাধিক ধর্মে প্রচলিত শতাধিক মত সত্য হইবে কিরূপে? যদি বলা হয় যে, সত্য হইবে একটি; তখন প্রশ্ন হইবে কোনটি এবং কেন? অর্থাৎ সত্যতা বিচারের মাপকাঠি (Criterion for truth) কি? সত্যতা প্রমাণের উপায় (Test for truth) কি এবং সত্যের রূপ (Nature of truth) কি?
আমরা ঐ সকল দুরূহ দার্শনিক তত্ত্বের অনুন্ধানে প্রবিষ্ট হইব না, শুধু ধর্ম-জগতের মতানৈক্যের বিষয় সামান্য কিছু আলোচনা করিব।
আমাদের অভিজ্ঞতা হইতে আমরা জানিতে পাইতেছি যে, বিশ্বমানবের সহজাত বৃত্তি বা “স্বভাবধর্ম” একটি। এ সংসারে সকলেই চায়-সুখে বাঁচিয়া থাকিতে, আহার-বিহার ও বংশরক্ষা করিতে, সন্তান-সন্ততির ভিতর দিয়া অমর হইতে। মানুষের এই স্বভাবধর্মরূপ মহাব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সংসারে সৃষ্টি হইল কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, সমাজ, নীতি এবং রাষ্ট্র; গড়িয়া উঠিল জ্ঞান-বিজ্ঞানময় এই দুনিয়া। মানুষ যেখানে যে কাজেই লিপ্ত থাকুক না কেন, একটু চিন্তা করিলেই দেখা যাইবে যে, সে তার “স্বভাবধর্ম” বনাম “স্বধর্ম” পালনে ব্রতী। এই মহাব্রত উদযাপনে কাহারো কোন প্ররোচনা নাই এবং এই ধর্ম পালনে মানুষের মধ্যে কোন মতানৈক্য নাই।
এই স্বভাবধর্মই মানুষের ধর্মের সবটুকু নয়। এমন কি “ধর্ম” বলিতে প্রচলিত কথায় এই স্বভাবধর্মকে বুঝায় না। যদিও একথা স্বীকৃত হইয়া থাকে যে পশু, পাখী, কীট, পতঙ্গ এমন কি জলবায়ু, অগ্নি ইত্যাদিরও এক একটা ধর্ম আছে, তত্রাচ বিশ্বমানবের ধর্ম বা “মানব-ধর্ম” বলিয়া একটি আন্তর্জাতিক ধর্মকে স্বীকার করা হয় না। সাধারণত আমরা যাহাকে “ধর্ম” বলি তাহা হইল মানুষের কল্পিত ধর্ম। যুগে যুগে মহাজ্ঞানীগণ এই বিশ্ব সংসারের স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। স্রষ্টার প্রতি মানুষের কি কোন কর্তব্য নাই? নিশ্চয়ই আছে, “এইরূপ চিন্তা করিয়া তাঁহারা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিয়া দিলেন। অধিকন্তু মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও দেখাইয়া দিলেন সেই মহাজ্ঞানীগণ। এইরূপে হইল কল্পিত ধর্মের আবির্ভাব। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মনীষী বা ধর্মগুরুদের মতবাদ হল ভিন্ন ভিন্ন।
এই কল্পিত ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল উহাতে মতভেদ। ফলে পিতা-পুত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে এমন কি স্বামী-স্ত্রীতেও এই কল্পিত ধর্ম নিয়া মতভেদের কথা শোনা যায়। এই মতানৈক্য ঘুচাইবার জন্য প্রথমত আলাপ আলোচনা পরে পরে বাক-বিতণ্ডা, শেষ পর্যন্ত যে কত রক্তপাত হইয়া গিয়াছে, ইতিহাসই তার সাক্ষী। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বমানব একমত হইতে পারিয়াছে কি?
কেবল যে বিভিন্ন মত এমন নহে। একই ধর্মের ভিতরেও মতভেদের অন্ত নাই। হিন্দু ধর্মের বেদ যাহা বলে উপনিষদ সকল ক্ষেত্রে তাহার সহিত একমত নহে। আবার পুরাণের শিক্ষাও অনেক স্থলে অন্যরূপ। “বাইবেল” এর পুরাতন নিয়ম (Old Testament) ও নূতন নিয়মে (New Testament) অনেক পার্থক্য। পুনশ্চ প্রোটেষ্ট্যান্ট (Protestant) ও ক্যাথলিকদের (Roman Catholic) মধ্যেও অনেক মতানৈক্য রহিয়াছে।
পবিত্র কোরানপন্থীদের মধ্যেও মতবৈষম্য কম নহে। শিয়া, সুন্নী, মুতাজিলা, ওহাবী, কাদিয়ানী, খারীজী ইত্যাদি সাম্প্রদায়ের মত এক নহে। আবার একই সুন্নী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ¬ হানাফী, শাফী ইত্যাদি চারি মজাহাবের মতামত সম্পূর্ণ এক নহে। এমন কি একই হানাফী মজহাব অবলম্বী বিভিন্ন পীর ছাহেবদের যথা জৌনপুরী, ফুরফুরা, শর্ষিণা ইত্যাদি বিভিন্ন খান্দানের বিভিন্ন রেছালা। মহাত্না রাজা রামমোহন রায়ের অতি আধুনিক ব্রাহ্মধর্মও আধুনা দুই শাখায় বিভক্ত হইয়াছে।
এতোধিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ভক্তদের নিকট আপন আপন ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ, সনাতন ও ঈশ্বর অনুমোদিত, মুক্তি বা পরিত্রাণের একমাত্র পন্থা। বলা বাহুল্য যে, এরূপ ধারণা প্রত্যেক ধর্মেই বিদ্যমান। কোন ধর্মে একথা কখনও স্বীকার করে না যে, অপর কোন ধর্ম সত্য অথবা অমুক ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বর্গপ্র্রাপ্তি, মুক্তি বা নির্বাণ ঘটিবে। বরং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মযাজকেরা এই কথাই বলিয়া থাকেন যে, তাঁহাদের আপন আপন ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম অন্যকোন ধর্মই সত্য নহে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বর্গপ্রাপ্তি, পরিত্রাণ, নির্বাণ বা মোক্ষলাভ ঘটিবে না। এ যেন বাজারের গোয়ালাদের ন্যায় সকলেই আপন আপন দধি মিষ্টি বলে।
বর্তমান যুগে পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মই আস্তিক। বিশেষত একেশ্বরবাদী। হিন্দু ধর্মও মূলত একেশ্বরবাদী। তাই যদি হয়, অর্থাৎ জগতের সকল লোকই যদি একেশ্বরবাদী হয়, তবে তাহাদের মধ্যে একটি ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত। কিন্তু আছে কি? আছে যত রকম হিংসা, ঘৃণা, কলহ ও বিদ্বেষ। সম্প্রদায় বিশেষে ভুক্ত থাকিয়া মানুষ মানুষকে এত অধিক ঘৃণা করে যে, তদ্রূপ কোন ইতর প্রাণীতেও করে না। হিন্দুদের নিকট গোময় (গোবর) পবিত্র অথচ অহিন্দু মানুষ মাত্রেই অপবিত্র। পক্ষান্তরে মুসলমানদের নিকট কবুতরের বিষ্ঠাও পাক অথচ অমুসলমান মাত্রেই নাপাক। পুকুরে সাপ, ব্যাঙ মরিয়া পচিলেও উহার জল নষ্ট হয় না, কিন্তু বিধর্মী মানুষে ছঁুইলেও উহা হয় অপবিত্র। কেহ কেহ একথাও বলেন যে, অমুসলমানী পর্ব উপলক্ষে কলা, কচু, পাঠা বিক্রিও মহাপাপ। এমন কি মুসলমানের দোকান থাকিতে হিন্দুর দোকানে কোন কিছু ক্রয় করাও পাপ। এই কি মানুষের ধর্ম? না ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা?
মানবতার মাপকাঠিতে মানুষ একে অন্যের ভাই, ভালবাসার পাত্র, দয়ামায়ার যোগ্য, সুখ-দুঃখের ভাগী; এক কথায় একান্তই আপন। কিন্তু ধর্মে বানাইল পর।
স্বভাবত মানুষ সত্যকেই কামনা করে, মিথ্যাকে নয়। তাই আবহমানকাল হইতেই মানুষ “সত্যের সন্ধান” করিয়া আসিতেছে। দর্শন বিজ্ঞান, ভূগোল ইতিহাস, গণিত প্রভৃতি জ্ঞাননুশীলনের বিভিন্ন বিভাগ সর্বদাই চায় মিথ্যাকে পরিহার করিতে। তাই কোন দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক, কোন ঐতিহাসিক কিংবা নৈয়ায়িক সজ্ঞানে তাহাদের গ্রন্থে মিথ্যার সন্নিবেশ করেন না। বিশেষত তাঁহারা তাহাদের গ্রন্থের ভূমিকায় এমন প্রতিজ্ঞাও করেন না যে, তাহাদের গ্রন্থের কোথায়ও কোন ভুলভ্রান্তি নাই। অথবা থাকিলেও তাহা তাঁহারা সংশোধন করিবেন না। পক্ষান্তরে যদি কাহারো ভুলত্রুটি প্রমাণিত হয়, তবে তিনি তাহা অ্লানবদনে স্বীকার করেন এবং উহা সংশোধনের প্রয়াস পাইয়া থাকেন। এইরূপ পরবর্তী সমাজ পূর্ববর্তী সমাজের ভুলত্রুটি সংশোধন করিয়া নিয়া থাকে। এইরকম যুগে যুগে যখনই অতীত জ্ঞানের মধ্যে কোন ভুল ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় তখনই উহার সংশোধন হইয়া থাকে। এক যুগের বৈজ্ঞানিক সত্য আরেক যুগে মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া যায় এবং যখনই উহা প্রমাণিত হয়, তখনই বৈজ্ঞানিক সমাজ উহাকে জীর্ণবস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করেন ও প্রমাণিত নূতন সত্যকে সাদরে গ্রহণ করেন।
ধর্মজগতে কিন্তু ঐরূপ নিয়ম পরিলক্ষিত হয় না। তৌরীত, জরুর, ইঞ্জিল, ফোরকান, বেদ-পুরান, জেন্দ-আভেস্তা ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থসমূহের প্রত্যেকটি অপৌরুষেয় বা ঐশ্বরিক পুথি কি না, তাহা জানি না, কিন্তু ইহাদের প্রত্যেকটি গ্রন্থ এই কথাই বলিয়া থাকে যে, এই গ্রন্থই সত্য। যে বলিবে যে, ইহা মিথ্যা, সে নিজে মিথ্যাবাদী, অবিশ্বাসী, পাপী অর্থাৎ নরকী।
ধর্মশাস্ত্রসমূহের এইরূপ নির্দেশ হেতু কে যাইবে ধর্মাস্ত্রসমূহের বিরুদ্ধে কথা বলিয়া নরকী হইতে? আর বলিয়াই বা লাভ কি? অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থই গ্রন্থকারবিহীন অর্থাৎ ঐশ্বরিক বা অপৌরুষেয়, সুতরাং উহা সংশোধন করিবেন কে?
প্রাগৈতিহাসিককাল হইতে জগতে শত শত রাষ্ট্রের উত্থান হইয়াছে এবং পরস্পর কলহবিবাদের ফলে তাহাদের পতন ঘটিয়াছে। কিন্তু ধর্মে ধর্মে যতই কলহবিবাদ থাকুক না কেন জগতে যতগুলি ধর্মের আবির্ভাব ঘটিয়াছে তাহার একটিও আজ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয় নাই। ইহার প্রথম কারণ হইল এই যে, রাষ্ট্রের ন্যায় ধর্মসমূহের আয়ত্তে তোপ, কামান, ডিনামাইট বা এ্যাটম বোম নাই, যাহা দ্বারা একে অন্যের ধ্বংস সাধন করিতে পারে। ধর্মের হাতে আছে মাত্র দুইটি অস্ত্র – আশীর্বাদ ও অভিশাপ। এহেন অস্ত্রসমূহ ব্যক্তি বিশেষের উপর ক্রিয়াশীল কি না, জানি না, কিন্তু কোন সম্প্রদায় বা জাতির উপর একেবারেই অকেজো।
উহার দ্বিতীয় কারণ এই যে, প্রত্যেক ধর্মেই তাহার নির্দিষ্ট বিধি-বিধান সমূহের সত্যাসত্যের সমালোচনা একেবারেই বন্ধ। যেমন পাপ ও নরকের ভয়ে ভিতরের সমালোচনা বন্ধ, তেমন বাহিরের (ভিন্ন ধর্মের লোকদের) সমালোচনা চিরকালই বাতিল। কাজেই ধর্ম নির্বিঘ্নে আপন মনে দিন কাটাইতেছে। কিন্তু এইখানেই কি শেষ? না, বোবারও কল্পনা শক্তি আছে। মুখে কিছু বলিতে না পারিলেও সে বিশ্বের ঘটনাবলী সম্পর্কে চিন্তা করে, সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বোবার সেই ভাব সমূহের অভিব্যক্তি ঘটে তাহার কার্যাবলীর মধ্য দিয়া।
ধর্মজগতে মানুষের স্বাধীন চিন্তা-ক্ষেত্র নিতান্তই অপরিসর। তাই বাঁধ-ভাঙ্গা জলস্রোতের ন্যায় সময় সময় মানুষের কল্পনা ধর্মের বাঁধ ভাঙ্গিয়া বিধি-নিষেধের গণ্ডির বাহিরে চলিয়া যায়। ধর্মশাস্ত্র যে সকল বিষয় ভাবিতে নিষেধ করিয়াছে, মানুষ তাহাও ভাবে এবং সমস্যার সমাধান না পাওয়ায় দুই এক-জন আনাড়ী লোক ধর্ম যাজকদের নিকটে গোপনে প্রশ্ন করে ইহা কেন? উহা কেন? সমস্যা যতই জটিল হউক না কেন, উহার সমাধান হয়ত জলের মত সোজা। যাজক জবাব দেন, “ঐ সকল গুপ্ততত্ত্ব সমূহের ভেদ সে (আল্লাহ) ছাড়া কেহই জানে না। ধরিয়া লও ওসকল তারই মহিমা,” ইত্যাদি।
ইংরাজীতে একটি কথা আছে যে, জ্ঞানই পূণ্য (Knowledge is virtue)। কিন্তু যে বিষয়ে কোন জ্ঞান জন্মিল না, সে বিষয়ে পুণ্য কোথায়? কোন বিষয় বা ঘটনা না দেখিয়াও বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু একেবারেই না বুঝিয়া বিশ্বাস করে কিরূপে? যাজক যখন দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, না দেখিয়া এমন কি না বুঝিয়াই ঐ সকল বিশ্বাস করিতে হইবে, তখন মনে বিশ্বাস না জন্মিলেও পাপের ভয়ে অথবা জাতীয়তা রক্ষার জন্য মুখে বলা হয় “আচ্ছা”। বর্তমানকালের অধিকাংশ লোকেরই ধর্মে বিশ্বাস এই জাতীয়।
এই যে জ্ঞানের অগ্রগতির বাধা, মনের অদম্য স্পৃহায় আঘাত, আত্মার অতৃপ্তি, ইহাই প্রতিক্রিয়া মানুষের ধর্ম-কর্মে শৈথিল্য। এক কথায় মন যাহা চায়, ধর্মের কাছে তাহা পায় না। মানুষের মনের ক্ষুধা অতৃপ্তই থাকিয়া যায়। ক্ষুধার্ত বলদ যেমন রশি ছিঁড়িয়া অন্যের ক্ষেতের ফসলে উদর পূর্তি করে, মানুষের মনও তেমন ধর্ম-ক্ষেত্রের সীমা অতিক্রম করিয়া ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য ছুটিয়া যায় দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।
ধর্মের মূল ভিত্তি বিশ্বাস (ঈমান)। ধর্ম এই বিশ্বাসকেই আঁকড়াইয়া আছে। কিন্তু এই বিশ্বাস কি বা ইহা উৎপত্তির কারণ কি, ধর্ম তাহা অনুসন্ধান করে না। এই বিশ্বে যাহার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে, নিশ্চয়ই তাহার উপাদান বা কারণ আছে। বিশ্বাস জন্মিবার যে কারণ সমূহ বর্তমান আছে, পণ্ডিতেরা তাহা অনুসন্ধান করিয়া দেখাইয়াছেন। বিশ্বাস উৎপত্তির কারণাবলী সূক্ষ্মরূপে আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে, মনোবিজ্ঞানের যে কোন পুস্তুকে উহা পাওয়া যাইবে। আমরা শুধু মোটামুটিরূপে উহার কিঞ্চিৎ আভাস দিব।
জ্ঞানের সহিত বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক। বরং বলা হইয়া থাকে যে, জ্ঞান মাত্রেই বিশ্বাস। তবে যে কোন বিশ্বাস জ্ঞান নহে। প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর যে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত, তাহাকেই জ্ঞান বলা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইহাই খাঁটি বিশ্বাস। পক্ষান্তরে যে বিশ্বাস কল্পনা, অনুভূতি, ভাবানুসঙ্গ বা কামনার উপর প্রতিষ্ঠিত তাহা জ্ঞান নহে। তাহাকে অভিমত (Opinion) বলা হইয়া থাকে। চলতি কথায় ইহার নাম “অন্ধ-বিশ্বাস”। সচরাচর লোকে এই অন্ধ-বিশ্বাসকেই “বিশ্বাস” আখ্যা দিয়া থাকে। কিন্তু যাহা খাঁটি বিশ্বাস, তাহা সকল সময়ই বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা (Lesson Experience) প্রসূত, প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর প্রতিষ্টিত। যাহা প্রত্যক্ষ তাহা সর্বদাই বিশ্বাস্য। মানুষ যাহা কিছু প্রত্যক্ষ করে, তাহা তাহার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই করে এবং যাহা কিছু প্রত্যক্ষ করে, তাহাই বিশ্বাস করে। আমি স্বচক্ষে যাহা দেখিয়াছি, স্বকর্ণে যাহা শুনিয়াছি, স্ব-হস্তে যাহা স্পর্শ করিয়াছি তাহাতে আমার সন্দেহের অবকাশ কোথায়? যাহা আমাদের প্রত্যক্ষীভূত, তাহাতেই আমাদের অটল বিশ্বাস।
সংসারে এমন বস্তুও আছে, যাহাকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। অথচ সেই সকল বস্তুকে যে আমরা সন্দেহ করি এমনও নহে। অনেক অপ্রত্যক্ষীভূত জিনিস আছে, যাহা আমরা সন্দেহ করি এমনও নহে। অনেক অপ্রত্যক্ষীভূত জিনিস আছে, যাহা আমরা অনুমানের ভিত্তিতেই বিশ্বাস করি। এই যে মানুষের ‘প্রাণ শক্তি’, যার বলে মানুষ উঠা, বসা, চলাফেরা ইত্যাদি সংসারের নানাপ্রকার কাজকর্ম করিতেছে, তাহা কি আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি? করি নাই। কারণ ‘প্রাণ’ মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহে। প্রাণকে কোনরূপে প্রত্যক্ষ না করিলেও প্রাণের অস্তিত্বে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ প্রাণ যদিও ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে, তবুও ইহার কার্যকলাপ দৈহিক ঘটনারূপে আমরা প্রত্যক্ষ করিতেছি। “কার্য থাকিলে তাহার কারণ থাকিতে বাধ্য” এই স্বতঃসিদ্ধ যুক্তির বলে আমরা দৈহিক ঘটনাবলীর কারণরূপে প্রাণের অস্তিত্বকে অনুমান করিতেছি এবং বিশ্বাস করিতেছি যে প্রাণ আছে।
পূর্বেই বলিয়াছি যে, প্রত্যক্ষ ও অনুমান, এই দুইটির উপর খাঁটি বিশ্বাস বা জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত। যে বিশ্বাসের মূলে প্রত্যক্ষ বা অনুমান নাই অর্থাৎ যে বিশ্বাসের মূলে জ্ঞানের অভাব, তাহা খাঁটি বিশ্বাস নহে, অন্ধ-বিশ্বাস। বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে আমাদের সন্দেহ নাই। বিজ্ঞান যাহা বলে, তাহা আমরা অকুণ্ঠিত চিত্তে বিশ্বাস করি। কিন্তু অধিকাংশ ধর্ম এবং ধর্মের অধিকাংশ তথ্য অন্ধবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ ধর্মীয় বিধি-বিধান প্রত্যক্ষ বা আনুমানসিদ্ধ নহে। এজন্য ধর্মের অনেক কথায় বা ব্যাখ্যায় সন্দেহ থাকিয়া যায়। দ্বিধাহীন চিত্তে ধর্মীয় সকল অনুশাসনকে আমরা সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। তাই বিজ্ঞানের ন্যায় ধর্মের উপর সকল লোকের অটল বিশ্বাস হয় না। ধর্মকে সন্দেহাতীতরূপে পাইতে হইলে উহাকে অন্ধবিশ্বাসের উপর রাখিলে চলিবে না, উহাকে খাঁটি বিশ্বাস অর্থাৎ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।
আজকাল যেখানে-সেখানে শোনা যাইতেছে যে, সংসারে নানাপ্রকার জিনিস-পত্রাদি হইতে “বরকত” উঠিয়া গিয়াছে। কারণ লোকের আর পূর্বের মত ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস নাই। পূর্বে লোকের ঈমান ছিল, ফলে তাহারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করিত। আর আজকাল মানুষের ঈমান নাই, তাই তাহাদের অভাব ঘোচে না। ঈমান নাই বলিয়াই ক্ষেতে আর সাবেক ফসল জন্মে না, ফলের গাছে ফল ধরে না, পুকুরে-নদীতে মাছ পড়ে না। ঈমান নাই বলিয়াই মানুষের উপর খোদার গজবরূপে কলেরা, বসন্ত, বন্যা-বাদল, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি নানা প্রকার বালা-মুছিবত নাজেল হয়। অথচ মানুষের হুঁশ হয় না। এইরূপ যে নানা প্রকার অভাব-অভিযোগের জন্য ঈমানের অভাবকেই দায়ী করা হয়, তাহা কতটুকু সত্য?
শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেই জানেন আর যাহারা জানেন না তাহারা অনুসন্ধান করিলেই জানিতে পারিবেন যে, আমাদের এই সোনার বাংলার চাষীগণ বিঘা প্রতি বার্ষিক যে পরিমাণ ধান্য জন্মাইতেছে তাহারা প্রায় সাত-আট গুণ পরিমাণ ধান্য জাপানের চাষীরা জন্মাইতেছে। হয়ত অনুসন্ধান করিলে ইহাও জানা যাইতে পারে যে, জাপানের এই চাষীরা অ-মুসলমান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, কাফের, যাহাদের ধর্মে ঈশ্বরের নামগন্ধও নাই। আমাদের মতে উহারা বে ঈমান বা অ-বিশ্বাসী। তবুও উহারা বৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতি প্রয়োগে পূর্বের চেয়ে বেশী ফসল জন্মাইতেছে। আমাদের মতে উহারা বে-ঈমান হইলেও তাহাদের ক্ষেতের ফসল বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই।
কিছুদিন পূর্বে রাশিয়া-প্রত্যাগত বাংলাদেশের জনৈক নামজাদা ডাক্তার সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বলিয়াছিলেন যে, পূর্ব বাংলায় প্রতি বৎসর হাজার হাজার লোক কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারীর প্রকোপে প্রাণ হারায় এ কথা সেদেশের ডাক্তারেরা বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না। কারণ তাহারা একথা ভাবিতেও পারিতেছিলেন না যে, বর্তমান যুগেও কোন দেশে কলেরা বা বসন্তে ভুগিয়া অগণিত মানুষ প্রাণ হারায়। তবে কি একমাত্র বাংলার অধিবাসীদেরই ঈমান নাই? আর একমাত্র ইহাদের উপরই কি খোদার গজব বর্ষিত হয়? রাশিয়ানরা অধিকাংশই সাম্যবাদী (Socialist)। তাঁহারা দেব-দেবী বা আল্লা-নবীর ধার ধারে না। তবুও যাবতীয় কাজে তাঁহারা বৈজ্ঞানিক প্রণালী প্রয়োগ করিয়াই সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন-যাপন করিতেছেন।
যাহারা ঈমানের অভাবকে নানাবিধ অভাব-অনটনের জন্য দায়ী করেন, তাঁহারা একটু ভাবিলেই দেখিতে পাইতেন যে, ধনী ও গরীবের আয়-ব্যয়ের ধাপগুলি কোন কালেই এক নহে। গরীব চায় শুধু ভাত ও কাপড়। কিন্তু ধনী চায় তৎসঙ্গে বিলাস-ব্যসন। মানুষ সাধারণত অনুকরণপ্রিয়! তাই ধনীর বিলাসিতা বহুল পরিমাণে ঢুকিয়াছে গরীবের ঘরে। যাহার পিতার সম্পত্তি ছিল পাঁচ ঘিা জমি এবং পরিবারে ছিল তিনজন লোক, তাহার সংসারের নানা প্রকার খরচ নির্বাহ করিয়াও হয়ত কিছু উদ্বৃত্ত থাকিত। আজও সে ঐ জমির আয় দ্বারা তিনজন লোকই প্রতিপালন করে, কিন্তু উদ্বৃত্ত যাহা কিছু থাকিত, তাহা ব্যয় করিতেছে সাবান, সুবাসিত তৈল, সিল্কের চাদর, ছাতা ও জুতায়। বিলাস ব্যসনে যে অতিরিক্ত খরচ সে করিতেছে, তাহার হিসাব রাখে না, ভাবে ‘বরকত’ গেল কোথায়? এ কথা সে ভাবিয়া দেখে না যে, অমিতব্যয়িতা এবং বিলাসিতাই তাহার অভাব-অনটনের কারণ। অযথা ঈমানের অভাবকে কারণ বলিয়া দায়ী করে।
প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে যেখানে (অখণ্ড ভারতে) জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৯ কোটি, বৃদ্ধি পাইয়া আজ সেখানে জনসংখ্যা দাঁড়াইয়াছে প্রায় ৬৯ কোটি। এই যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ৩৯ কোটি মানুষ ইহারা খায় কি? লোক বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য বৃদ্ধি না হইলে খাদ্যখাদকের সমতা থাকিবে কিরূপে? লোক বৃদ্ধি যতই হোক জমি বৃদ্ধির উপায় নাই। কাজেই অনাবাদী জমি আবাদ, উপযুক্ত সার প্রয়োগ, উৎকৃষ্ট বীজ ব্যবহার ও বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে চাষাবাদ ছাড়া বর্তমানে খাদ্য বৃদ্ধির উপায় নাই। অথচ আমাদের দেশে কয়জন চাষী এবিষয়ে সচেতন? আজও সরকারী বীজ ভাণ্ডারে ভাল বীজ বিকায় না। এমোনিয়া সালফেট ও বোনমিল বস্তা ছিঁড়িয়া পড়িয়া থাকে গুদামের মেঝেয়, রেড়ির খৈল পচিয়া থাকে গুদামে। পল্লী অঞ্চলে ইতস্তত ঝোপ-জঙ্গলের অভাব নাই, বসত বাড়ীর আনাচে-কানাচে জন্মিয়া থাকে ভাইট গাছ আর গুড়ি কচু। বেড় পুকুরে কচুরী পানা ঠাসা। বৃদ্ধি পাইয়াছে শুধু মশা, মাছি ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত আর ডাক্তার খরচ। এইত আমাদের অশিক্ষিত দেশের অবস্থা। বর্তমানের খাদ্যের অভাব ঘটিয়াছে তাহা সত্য। কিন্তু ইহা খাদ্যখাদকের সমতার অভাবেই ঘটিয়াছে, “বে-ঈমান” বা অবিশ্বাসের জন্য নয়।
ম্যালথুস (Malthus) তাঁর “পপুলেশন” নামক গ্রন্থে বলিয়াছেন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি অনুপাত আছে, যে অনুপাত জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। তবে দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসাধারণের আহার-বিহার এবং রীতি-নীতি তারতম্যে সামান্য ব্যতিক্রম ঘটিতে পারে।
আমাদের দেশের জন্ম-হার অত্যধিক, জনসংখ্যা অস্বাভাবিক রূপে বৃদ্ধি পাইতেছে শিশু, বিধবা ও বহুবিবাহে। যে ছেলের ২০ বৎসর বয়সে বিবাহ হওয়া উচিত, সে ছেলের ঐ বয়সে ছেলে-মেয়ে জন্মে দুই তিনটি। আবার তিন বৎসর বয়সে যে মেয়ের বিবাহ হয়, বারো-তেরো বৎসর বয়সে সে হয় মেয়ের মা। কথায় বলে “কচি ফলের বীজ ভাল না।” অপ্রাপ্ত বয়স্ক পিতা-মাতার সন্তান উৎপাদনে পিতা-মাতা ও শিশু উভয়ই হয় স্বাস্থ্যহীন। পিতার বয়স ত্রিশ হইলে চুল পাকে, পঁয়ত্রিশে দাঁত নড়ে, চল্লিশে হয় কঁুজো, হাঁপানি ও প্রবাহিকায় পঞ্চাশেই ভবলীলা সঙ্গে করে। এমতাবস্থায় বিধবা স্ত্রীর উপায় কি? কোন ছেলের ব্যথার ব্যারাম, কোন ছেলের জীর্ণজ্বর, ছোট মেয়েটি কোলে লয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা। এইরূপ স্বাস্থ্যহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া দেশের অভাব দৈনন্দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। আর ইহার সাথে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অলসতা ও কুসংস্কার প্রভৃতি ত আছেই। সুখের বিষয় এই যে, সরকারী নির্দেশে শিশু বিবাহটা বর্তমানে কমিয়াছে।
বহুবিবাহের প্রতিক্রিয়াও সমাজ জীবনে কম নহে। ইহা শুধু বংশবিস্তার করিয়াই ক্ষান্ত থাকে না। ইহার ফলে নানাপ্রকার পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। বৈমাত্রেয় সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধির ফলে উহাদের মধ্যে ফরায়েজের অংশ লইয়া মানোমালিন্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা অবশেষে মামলা-মোকর্দ্দমা ও উকিল-মোক্তার, আমলা-পেস্কার ইত্যাদির হয় আয় বৃদ্ধি।
জন্ম বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুতেও নিস্তার নাই, ইহাতেও খরচ আছে। প্রথমত জানাজা, কাফন ইত্যাদি খরচ ত আছেই তদুপরি মোর্দাকে গোর-আজাব হইতে রক্ষা করিতে, পোলছিরাত পার করিতে, বেহেস্ত সহজলভ্য করিতে প্রতি বৎসর রমজান মাসে মৌলুদ শরীফ, কোরান শরীফ খতম ইত্যাদি না-ই হোক, অন্ততপক্ষে কয়েকজন মোল্লা-মৌলবী ডাকিয়া তশবিহ্ পড়াইয়া কিছুটা ডা’ল-চা’ল খরচ না করিলেই চলে না। মানুষের অভাব বৃদ্ধির কারণাবলীর প্রতি চক্ষু মুদিয়া থাকিয়া উগ্রবিশ্বাসীরা ঈমানের অভাবকেই অভাব-অনটনের কারণ বলিয়া সাব্যস্ত করিতেছে।
“এখন আর মানুষের মনে পূর্বের ন্যায় ঈমান নাই”, এ কথা বলিয়া যাঁহারা রোদন, করেন, তাঁহারা একটু ভাবিয়া দেখিতে পারেন যে, বিশ্বাস গেল কোথায়? বিজ্ঞান মতে পদার্থের ধ্বংস নাই, আছে শুধু পরিবর্তন। দেখা যায় তদ্রূপ মানব মনের বিশ্বাসেরও লয় নাই, আছে শুধু পরিবর্তন। পূর্বে লোকে নানা প্রকার উপকথা, রূপকথায়ও বিশ্বাস করিত। কিন্তু এখন আর তাহা করে না। নানা প্রকার ভূতের গল্প, জ্বীন-পরীর কাহিনী, নানা প্রকার তন্ত্র-মন্ত্র অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেই আজকাল আর বিশ্বাস করেন না। তবে যে উহা সমাজে একেবারেই অচল, তাহা নহে। “রূপকথা” লোকে রূপকথা বলিয়াই গ্রহণ করিতেছে, “সত্য” বলিয়া মনে করিতেছেন না। এক সময় উপন্যাসকে লোকে ইতিহাস মনে করিত। কিন্তু এখন আর তাহা করে না, ম্যাজিকের আশ্চর্য খেলাগুলি সকলেই আগ্রহের সহিত দেখে, কিন্তু তাহা সত্য বলিয়া কেহ বিশ্বাস করে না। তাই বলিয়া ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিশ্বাস মুছিয়া যায় নাই। যেমন কতক বিষয় হইতে বিশ্বাস উঠিয়া গিয়াছে, তেমন কতক বিষয়ে বিশ্বাস মুছিয়া যায় নাই। যেমন কতক বিষয় হইতে বিশ্বাস উঠিয়া গিয়াছে, তেমন কতক বিষয়ে বিশ্বাস জন্মাইয়াছে, বিশ্বাসযোগ্য “বস্তু” বা “বিষয়” এর পরিবর্তন হইয়াছে মাত্র।
বলা হয় যে, আল্লাহ তা’লার অসাধ্য কোন কাজ নাই। বিশেষ বিশ্বাসী ভক্তদের অনুরোধে তিনি অসম্ভবকেও সম্ভব করেন। হযরত সোলায়মান নবী নাকি সিংহাসনে বসিয়া সপরিষদ শূন্যে ভ্রমণ করিতেন। তাই বলিয়া “আল্লাহ তা’লা ইচ্ছা করিলে জায়নামাজ শুদ্ধ আমাকেও নিমিষের মধ্যে মক্কায় পৌঁছাইতে পারেন” এইরূপ বিশ্বাস কোন কোন পীর ছাহেবের আছে কি? থাকিলে একবারও তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন কি? না দেখিয়াই বা উড়ো জাহাজে চড়িবার কারণ কি? উড়োজাহাজে চড়িবার বিপদ আছে, ভাড়া আছে আর সময়ও লাগে যথেষ্ট। তবুও উহার উপর জন্মিয়াছে বিশ্বাস।
অতীতে কোন কোন বোজর্গান হাটিয়াই নদী পার হইতে পারিতেন। যেহেতু তাঁহাদের বিশ্বাস ছিল যে, নদী পার করাইবেন আল্লাহতা’লা, নৌকা বা জলাযানের প্রয়োজন নাই। আর বর্তমানে খোদার উপর বিশ্বাস নাই, নদী পার হইতে সাহায্য লইতে হয় নৌকার।
সুফীগণ নাকি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পৃথিবীর কোথায় কি ঘটিতেছে, তাহা জানিতে ও দেখিতে পাইতেন। এখন কয়টি লোকে উহা বিশ্বাস করে? বর্তমানে বিশ্বাস জন্মিয়াছে টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও এবং টেলিভিশনে।
শাহছাহেবদের “কালাম”-এর তাবিজে কৃমি পড়ে না, কৃমি পড়ে স্যান্টোনাইন কুইনাইন সেবনে। মানত সিন্নিতে জ্বর ফেরে না, জ্বর ফেরাইতে সেবন করিতে হয় কুইনাইন। লোকে বিশ্বাস করিবে কোনটি? নানাবিধ রোগারোগ্যের জন্য পীরের দরগাহ হইতে হাসপাতালকেই লোকে বিশ্বাস করে বেশী। গর্ভিনীর সন্তান প্রসব যখন অস্বাভাবিক হইয়া পড়ে, তখন পানি পড়ার চেয়ে লোকে বেবী ক্লিনিকের (Baby Clinic) উপর ভরসা রাখে বেশী।
আজ মহাসমুদ্রের বুকে লোক যাতায়াত করে কোন বিশ্বাসে? সমুদ্রের গভীর জলের নীচে লোকে সাবমেরিন চালায় কোন বিশ্বাসে? মহাকাশ পাড়ি দেয় লোকে কোন বিশ্বাসে? যন্ত্রে বিশ্বাস আছে বলিয়াই মানুষ যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করিতেছে। দ্রব্যগুণে বিশ্বাস আছে বলিয়াই লোকে কলেরা-বসন্তের সময় দোয়া-কালামের পরিবর্তে ইনজেকশন ও টীকা লইতেছে।
পূর্বেই বলিয়াছি যে, বিশ্বাস ধরাপৃষ্ঠ হইতে অবলুপ্ত হয় নাই, শুধু বিশ্বাসযোগ্য বিষয় বস্তুর পরিবর্তন হইয়াছে মাত্র। চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রেই বুঝিতে পারিবেন যে, যেখানে যে বিষয়ে মানুষের জ্ঞান জন্মিতেছে সেইখানেই বিশ্বাস (ঈমান) দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর হইতেছে আর যেখানে যে বিষয়েতে জ্ঞান জন্মে নাই, জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয় হইতে ক্রমশ বিশ্বাস লোপ পাইতেছে। অর্থাৎ সন্দেহ জাগিতেছে। যে কথায় বা যে বিষয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন প্রমাণ নাই, যে বিষয় কার্য কারণ সম্পর্ক নাই বা যাহা বিবেক বিরোধী, বর্তমানে শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রেই সে সকল ব্যাপারে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারেন না।
ধর্মজগতে এমন কতগুলি বিধি-নিষেধ, আচার-অনুষ্ঠান ও ঘটনাবলীর বিবরণ পাওয়া যায়, যাহার যুক্তিযুক্ত কোন ব্যাখ্যা সাধারণের বোধগম্য নহে। তাই সততই মনে কতগুলি প্রশ্ন উদয় হয় এবং সেই প্রশ্নগুলির সমাধানের অভাবে ধর্মের বিধি-বিধানের উপর লোকের সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্মে। ফলে ধর্মের বিধি-বিধানের উপর লোকের শৈথিল্য ঘটে। ধর্মযাজকদের অধিকাংশের নিকটই সেই সকল প্রশ্নাবলীর সদুত্তর পাওয়া যায় না। অনেক সময় উত্তর দেওয়া দূরে থাক শুধু প্রশ্ন করার জন্য উল্টা কাফেরী ফতুয়া দিতেও তাহাদের দেরী হয় না। অথচ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি তাহাদের মতানুযায়ী পালন না করিলে তাহার উপর তাহারা সাধ্যমত দল বাঁধিয়া অত্যাচার করিতেও ইতস্তত করে না। ধর্মের নাম করিয়া ধর্ম বিরোধী কাজ করিতেও উহাদের বাধে না। পবিত্র কোরান যে বলিতেছে “লা ইক্রাহা ফিদ্দীন,” অর্থাৎ ধর্মে জবরদস্তি নাই, সেদিকে উহারা ভ্রূক্ষেপ করে না। অধিকন্ত সরকারী আইন বাঁচাইয়া যতদূর ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়, তাহা করিতেও ত্রুটি করে না। উপরন্ত রাজশক্তিকে হস্তগত করিয়া ধর্মের নামে অধর্মকে চালাইবার আকাশ-কুসুমও উহারা রচনা করিতেছে।
ধর্মরাজ্য সম্বন্ধে চিন্তা করিলে সাধারণত মনে যে সকল প্রশ্নের উদয় হয়, আমরা এখন তাহার কতগুলি প্রশ্ন বিবৃত করিব এবং প্রশ্নগুলি কেন হইতেছে, তার হেতু স্বরূপ যথাযোগ্য বাখ্যা প্রশ্নের সহিত সন্নিবেশিত করিব।
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1795#sthash.QbDefoce.dpuf
০২.প্রথম প্রস্তাব
[আত্মা বিষয়ক] ঃ
১। আমি কে?
মানুষের আমিত্ববোধ যত আদিম ও প্রবল তত আর কিছুই নহে। আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি দেখিতেছি, আমি শুনিতেছি, আমি বাঁচিয়া আছি, আমি মরিব ইত্যাদি হাজার হাজার রূপে আমি আমাকে উপলব্ধি করিতেছি। কিন্তু যথার্থ “আমি” — এই রক্ত-মাংস, অস্থি, মেদ-মজ্জা-গঠিত দেহটাই কি “আমি”? তাই যদি হয়, তবে মৃত্যুর পরে যখন দেহের উপাদান সমূহ পচিয়া-গলিয়া অর্থাৎ রাসায়নিক পরিবর্তনে কতগুলি মৌলিক ও যৌগিক পদার্থে রূপান্তরিত হইবে, তখন কি আমার আমিত্ব থাকিবে না? যদি না-ই থাকে, তবে স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কে? নতুবা “আমি” কি আত্মা? যদি তাহাই হয়, হবে আত্মাকে “আমি” না বলিয়া “আমার”, ইহা বলা হয় কেন? যখন কেহ দাবী করে যে, দেহ আমার, প্রাণ আমার এবং মন আমার, তখন দাবীদারটা কে?
২। প্রাণ কি অরূপ না সরূপ?
প্রাণ যদি অরূপ বা নিরাকার হয়, তবে দেহাবসানের পরে বিশ্বজীবের প্রাণসমূহ একত্র হইয়া একটি অখণ্ড সত্তা বা শক্তিতে পরিণত হইবে না কি? অবয়ব আছে বলিয়াই পদার্থের সংখ্যা আছে, নিরবয়ব বা নিরাকারের সংখ্যা আছে কি? আর সংখ্যা না থাকিলে তাহার স্বাতন্ত্র্য থাকে কি? পক্ষান্তরে প্রাণ যদি সরূপ বা সাকার হয়, তবে তাহার রূপ কি?
৩। মন ও প্রাণ কি এক?
সাধারণত আমরা জানি যে, মন ও প্রাণ এক নহে। কেননা উহাদের চরিত্রগত পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা আমাদের নিজেদের উপলব্ধি হইতে জানিতে পাইতেছি যে, “মন” প্রাণের উপর নির্ভরশীল কিন্তু “প্রাণ” মনের উপর নির্ভরশীল নয়। মন নিষ্ক্রিয় থাকিলেও প্রাণের অভাব পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু প্রাণ নিষ্ক্রিয় হইলে মনের অস্তিত্বই থাকে না। যেমন ক্লোরোফরম প্রয়োগে মানুষের সংজ্ঞা লোপ ঘটে, অথচ দেহে প্রাণ থাকে, শ্বাসক্রিয়া, হৃৎক্রিয়া এমন কি পরিপাক ক্রিয়াও চলিতে থাকে। অথচ তখন আর মনের কোন ক্রিয়াই প্রকাশ পায় না। গভীর সুনিদ্রাকালেও কোন সংজ্ঞা থাকে না, ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, প্রাণবিহীন মন থাকিতেই পারে না, কিন্তু মন বা সংজ্ঞাহীন প্রাণ অনেক সময়ই পাওয়া যায়। ইহাতে অনুমতি হয় যে, মন আর প্রাণ এক নহে। ইহাও অনুমতি হয় যে, সংজ্ঞা চেতনা বা সুখ-দুঃখের অনুভূতি মনেরই, প্রাণের নয়। প্রাণ রাগ, শোক, ভোগ ও বিলাসমুক্ত। এক কথায় প্রাণ চির নির্বিকার।
জীবের জীবন নাকি যমদূত (আজরাইল) হরণ করেন। কিন্তু তিনি কি প্রাণের সহিত মনকেও হরণ করেন? অথবা প্রাণ যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, মনকে তৎসঙ্গে থাকিতেই হইবে, এরূপ কোন প্রমাণ আছে কি? নতুবা মনবিহীন প্রাণ পরকালের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কিরূপে?
৪। প্রাণের সহিত দেহ ও মনের সম্পর্ক কি?
দেহ জড় পদার্থ। কোন জীবের দেহ বিশ্লেষণ করিলে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, লৌহ, ফসফরাস ইত্যাদি নানা প্রকার মৌলিক পদার্থের বিভিন্ন অনুপাতে অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। পদার্থসমূহ নিষ্প্রাণ। কাজেই পদার্থসমূহের যথানুপাতে সংমিশ্রিত অবস্থাকেই প্রাণ বলা যায় না। পদার্থ সমূহের যথানুপাতে সংমিশ্রণ এবং আরও কিছুর ফলে দেহে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। ঐ “আরও কিছু” কে আমরা মন বলিয়া থাকি। কিন্তু মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে কিছু সম্পর্ক বা বন্ধন আছে কি? থাকিলে তাহা কিরূপ? আর না থাকিলেই বা উহারা একত্র থাকে কেন?
৫। প্রাণ চেনা যায় কি?
কোন মানুষকে “মানুষ” বলিয়া অথবা কোন বিশেষ ব্যক্তিকে আমরা তাহার রূপ বা চেহারা দেখিয়াই চিনিতে পাই, প্রাণ দেখিয়া নয়। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সকলকে রূপ দেখিয়াই চিনি, সম্বোধন করি, তাহাদের সাথে প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম নিষ্পন্ন করি। প্রাণ দেখিয়া কাহাকেও চিনিবার উপায় নাই। তদ্রূপ পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা ইত্যাদিকে আমরা উহাদের রূপ দেখিয়াই চিনিয়া থাকি। এই রূপ বা চেহারা দেহীর দেহেই প্রকাশ পাইয়া থাকে। যখন দেহের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্কে থাকিবে না অর্থাৎ মৃত্যুর পরে দেহহীন প্রাণকে চিনিবার উপায় কি? বিভিন্ন ব্যক্তি বা জীবের মন, জ্ঞান ও দৈহিক গঠনে যতই বৈচিত্র্য থাকুক না কেন, উহাদের প্রাণেও কি তেমন বৈচিত্র্য আছে? অর্থাৎ বিভিন্ন জীবের প্রাণ কি বিভিন্ন রূপ?
৬। আমি কি স্বাধীন?
“আমি” মনুষ্যদেহধারী মন-প্রাণবিশিষ্ট একটি সত্তা। প্রাণশক্তি বলে আমি বাঁচিয়া আছি, মনে নানাপ্রকার কার্য করিবার স্পৃহা জাগিতেছে এবং দেহের সাহায্যে উক্ত কার্যাবলী নিষ্পন্ন করিতেছি। আমি যে শারীরিক ও মানসিক শক্তির অধিকারী, তাহা আমার কার্যাবলীর মধ্যেই প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন এই যে, আমি স্বাধীন কি না। যদি আমি স্বাধীন হই অর্থাৎ আমার কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ঈশ্বরের না থাকে, তাহা হইলে তাঁহার “সর্বশক্তিমান” নামের সার্থকতা থাকে কি? আর যদি আমি স্বাধীন না-ই হই, তবে আমার কার্যাবলীর ফলাফল স্বরূপ পাপ বা পুণ্যের জন্য আমি দায়ী হইব কিরূপে?
৭। অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকিবে?
মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কোন একটির অভাব থাকিলে, ঐ ইন্দ্রিয়টির মাধ্যমে যে জ্ঞান হইতে পারিত, তাহা আর হয় না। যে অন্ধ বা বধির, সে আলো বা শব্দে জ্ঞান পাইতে পারে না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অভাবে জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুতে মানুষের দেহ নষ্ট হয় এবং তৎসঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলিও নষ্ট হয়। এখন প্রশ্ন এই যে, মৃত্যুর পরে শরীর ও ইন্দ্রিয়বিহীন আত্মার জ্ঞান থাকিবে কি? থাকিলে তাহা কিরূপে থাকিবে?
৮। প্রাণ কিভাবে দেহে আসা-যাওয়া করে?
কেহ কেহ বলেন যে যাবতীয় জীবের বিশেষত মানুষের প্রাণ একই সময় সৃষ্টি হইয়া “ইল্লিন” নামক স্থানে রক্ষিত আছে। তথা হইতে রমণীদের গর্ভের তৃতীয় কি চতুর্থ মাসে প্রাণ ভ্রূণে আবির্ভূত হয়। গর্ভস্থ শিশুর দেহে আল্লাহ তা’লার হুকুমে প্রাণ নিজেই আসে, না কোন ফেরেস্তা প্রাণকে শিশুর দেহে ভরিয়া দিয়া যায়, তাহা জানি না; কিন্তু ধর্মাধ্যায়ীগণ ইহা নিশ্চিত করিয়াই বলেন যে, একটি জীবের দেহে একটি প্রাণই আমদানী হয়। ইহা কেহ কখনও বলেন না যে, একটি জীবের একাধিক প্রাণ থাকিতে পারে বা আছে। “পঞ্চপ্রাণ” বলিয়া যে একটি বাক্য আছে, যথা, প্রাণ, আপ্রাণ, সমান, উদান ও ধ্যান, উহা হইল শরীরস্থ বায়ুর পাঁচটি অবস্থা মাত্র। প্রাণশক্তি একই।
সচরাচর এক গর্ভে মানুষ জন্মে একটি। কিন্তু বিড়াল, কুকুর, ছাগল ও শৃগালাদি প্রায়ই একাধিক জন্মিয়া থাকে। মানুষেরও যমজ সন্তান হওয়া চলতি ঘটনা, ক্বচিৎ চারি-পাঁচ বা ততোধিক সন্তান জন্মিবার কথাও শোনা যায়। ঐ সকল ক্ষেত্রে কি প্রতি গর্ভে একাধিক প্রাণ আমদানী হয়, না একটি প্রাণই বিভক্ত হইয়া বহুর সৃষ্টি হয়।
কেঁচো ও শামুকাদি ভিন্ন যাবতীয় উন্নত জীবেরই নারী-পুরুষ ভেদ আছে, কচিৎ নুপংসকও দেখা যায়। কিন্তু জীব জগতে নারী ও পুরুষ, এই দুই জাতিই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। প্রতিটি জীব বা মানুষ জন্মিবার পূর্বেই যদি তার স্বতন্ত্র সত্ত্বাবিশিষ্ট প্রাণ সৃষ্টি হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই প্রাণেরও লিঙ্গভেদ আছে কি? যদি থাকেই তাহা হইলে অশরীরী নিরাকার প্রাণের নারী, পুরুষ এবং ক্লীবের চিহ্ন কি? আর যদি প্রাণের কোন লিঙ্গভেদ না থাকে, তাহা হইলে এক জাতীয় প্রাণ হইতে ত্রিজাতীয় প্রাণী জন্মে কিরূপে? লিঙ্গভেদ কি শুধু জীবের দৈহিক রূপায়ণ মাত্র? তাহাই যদি হয়, তবে পরলোকে মাতা-পিতা, ভাই-ভগিনী ইত্যাদি নারী-পুরুষ ভেদ থাকিবে কিরূপে? পরলোকেও কি লিঙ্গজ দেহ থাকিবে? প্রকৃতির নিয়মানুসারে কোন জীবের দেহে প্রাণ না থাকিলে সে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। বরং নির্জীবদেহ জৈবধর্ম হারাইয়া জড় পদার্থের ধর্ম পায় এবং তাহা নানারূপ রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে রূপান্তর গ্রহণ করে। অর্থাৎ পচিয়া গলিয়া নষ্ট হইয়া যায়। মাতৃগর্ভস্থ মানবশিশু যদি তিন-চারি মাস বয়সের সময়ে প্রাণ প্রাপ্ত হয়, তবে সে মাতা-পিতার মিলন মুহূর্তের পর হইতে নিষ্প্রাণ (ভ্রূণ) অবস্থায় বৃদ্ধি পায় কেন এবং পচিয়া গলিয়া নষ্ট হইয়া যায় না কেন? প্রাণের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, কোন কোন বৃক্ষের একটি হইতে দশটি শাখা কাটিয়া রোপণ করিলে তাহা হইতে পৃথক পৃথক দশটি জীবিত বৃক্ষের উৎপত্তি হয়। এই রোপিত দশটি বৃক্ষের যে দশটি স্বতন্ত্র জীবন, ইহা কোথা হইতে, কোন সময় কিভাবে আসে? স্বর্গ হইতে কোন দূতের মারফতে, না পূর্ব বৃক্ষ হইতে? সদ্য বধ করা গরু, মহিষ বা ছাগলাদির কাটা মাংস যাহারা স্বহস্তে নাড়া-চড়া করিয়াছেন, তাহারা কেহ কেহ হয়ত লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন, কতগুলি খণ্ডিত মাংস আঘাতে সাড়া দেয়। যে জন্তুটিকে বধ করিবার পর তার দেহ শত শত খণ্ডে খণ্ডিত করা হয়, তার সেই মাংস খণ্ডগুলি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকিয়া আঘাতে সাড়া দেয় বা স্পন্দিত হয় কেন? কোন রকম আঘাতে সাড়া দেওয়াটা জীবন বা জীবিতের লক্ষণ, কিন্তু মৃত প্রাণীর মাংসখণ্ডে জীবন কোথা হইতে আসে? কোন জীবের জীবন যমদূত হরণ করিয়া লওয়ার পরেও কি প্রাণের কিছু অংশ জীবদেহে থাকিতে পারে? আর থাকিলেও কি একটি প্রাণের শত শত খণ্ডে খণ্ডিত হওয়া সম্ভব?
জীবতত্ত্ববিদ পণ্ডিতগণ বলেন যে, প্রাণীদেহ কতগুলি জীবকোষ (Cell)-এর সমবায়ে গঠিত। জীবকোষগুলি প্রক্যেকে জীবন্ত। অর্থাৎ প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে জীবিত। সাপ, কেঁচো, টিকটিকি ইত্যাদির লেজ কাটিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলে, তাহা দেহ হইতে দূরে পড়িয়াও লাফাইতে থাকে। এক্ষেত্রে জন্তুটির একটি প্রাণ দুইস্থানে থাকিয়া নড়াচড়া করিতেছে না। লেজস্থিত জীব কোষগুলি স্বতন্ত্র জীবনের কিছু সময় বাঁচিয়া থাকিতে পারে, তেমন স্বতন্ত্রভাবে মরিতেও পারে। মানুষের খোস, পাঁচড়া, দাদ ইত্যাদি এবং কতিপয় ক্ষত রোগ আরোগ্য হইলে রুগ্নস্থান হইতে যে মরামাস (মৃত চর্মের ফুসকুরী) উঠিয়া থাকে, উহাই জীবকোষের স্বতন্ত্র মৃত্যুর নিদর্শন। ইহা ভিন্ন যে কোন জীবিত বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার মৃত্যুতেও জীবকোষের স্বতন্ত্র মৃত্যু সূচিত করে।
একটি জীবকোষ বিভাজন প্রাণালীতে দুইটিতে, দুইটি হইতে চারিটি এবং তাহা হইতে আটটিতে পরিণত হয়। এই রূপ ক্রমান্বয়ে সংখ্যায় বৃদ্ধি হইয়া একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণী সৃষ্টি হয়। মানুষের বেলায়ও একটি মাত্র ডিম্ব কোষ (Egg cell) আর একটি জনন কোষ (Germ cell) একত্র মিলিত হইয়া বিভাজন প্রণালীতে সংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া একটি পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দেহে বহু কোটি জীবকোষের সমষ্টি হইয়া দাঁড়ায়। একটি মানুষের প্রাণ বহু কোটি প্রাণের সমবায়ী শক্তি। আমরা উহার নাম দিতে পারি “মহাপ্রাণ”। কাজেই একটি জন্তুর দেহে প্রাণ “বহু”, কিন্তু “মহাপ্রাণ” একটি। জীব দেহের যাবতীয় জীব কোষের এককালীন মৃত্যুকে অর্থাৎ মহাপ্রাণের তিরোধানকে আমরা জীবের “মৃত্যু” বলি এবং জীব দেহের কোন অংশের জীব কোষের মৃত্যুকে বলি “রোগ”।
উপরোক্ত ধর্মীয় ও জীবতত্ত্বীয় মতবাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনটি?
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1796#sthash.dNpAL91p.dpuf
০৩. দ্বিতীয় প্রস্তাবঃ-
[ঈশ্বর বিষয়ক]ঃ
১। আল্লাহর রূপ কি?
জগতের প্রায় সকল ধর্মই এ কথা স্বীকার করে যে, ঈশ্বর অদ্বিতীয় নিরাকার ও সর্বব্যাপী। কথা কয়টি অতীব সহজ ও সরল। কিন্তু যখন হিন্দুদের মুখে শোনা যায় যে, সৃষ্টি পালনের উদ্দেশ্যে ভগবান মাঝে মাঝে সাকারও হইয়া থাকেন ও যুগে যুগে “অবতার” রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া লীলা প্রকাশ করেন এবং যখন খৃষ্টানদের নিকট শোনা যায় যে, পরম সত্তা “ভগবান, মশীহ্, পরমাত্মা” — এই ত্রিত্বে প্রকাশ পাইতেছে; আবার যখন মুসলিম ধর্মযাজকদের নিকট শোনা যায় যে, আল্লাহতা’লা আরশে “কুরছির” উপর বসিয়া রেজওয়ান নামক ফেরেস্তার সাহায্যে বেহেস্ত, মালেক নামক ফেরেস্তার সাহায্যে দোজখ, জেব্রাইলের সাহায্যে সংবাদ এবং মেকাইলকে দিয়া খাদ্য বণ্টন ও আবহাওয়া পরিচালনা করেন — তখনই মন ধাধাঁয় পড়ে, বৃদ্ধি বিগড়াইয়া যায়। মনে প্রশ্ন জাগিতে থাকে — নিরাকার সর্বশক্তিমান ভগবানের সৃষ্টি পালনে সাকার হইতে হইবে কেন? অদ্বিতীয় ঈশ্বরের মহত্ত্ব প্রকাশে ত্রিত্বের আবশ্যক কি? সর্বব্যাপী আল্লাহ্তা’লার স্থায়ী আসনে অবস্থান কিরূপ এবং বিশ্বজগতের কার্য পরিচালনার জন্য ফেরেস্তার সাহায্যের আবশ্যক কি?
২। খোদাতাআ’লা কি মনুষ্য ভাবাপন্ন?
আল্লাহ্তা’লা দেখেন, শোনেন, বলেন ইত্যাদি শুনিয়া সাধারণ মানুষের মনে স্বতঃই প্রশ্ন জাগে — তবে কি আল্লাহ্র চোখ, কান ও মুখ আছে? কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে আছে। তবে তাহা মানুষের মত নয়, কুদরতি। কিন্তু “কুদরতি” বলিতে কিরূপ বুঝায়, তাহা তাঁহারা ব্যাখ্যা করেন না। আবার যখন শোনা যায় যে, খোদাতা’লা অন্যায় দেখিলে ক্রুদ্ধ হন, পাপীদের ঘৃণা করেন, কোন কোন কাজে খুশী হ’ন ও কোন কোন কাজে হ’ন বেজার। তখন মানুষ ভাবে খোদার কি মানুষের মতই মন আছে? আর খোদার মনেবৃত্তিগুলি কি মানুষেরই অনুরূপ? ইহারও উত্তর আসে যে, উহা বুঝিবার ক্ষমতা মানুষের নাই। আবার যখন চিন্তা করা যায় যে, খোদাতা’লার জগত-শাসন প্রণালী বহুলাংশে একজন সম্রাটের মত কেন এবং তাঁর এত আমলা-কর্মচারীর বাহুল্য কেন? উহার উত্তর পাওয়া যায় যে, সম্রাট হইলে তিনি অদ্বিতীয় সম্রাট, বাদশাহের বাদশাহ্, ক্ষমতার অসীম। উত্তর যাহা পাওয়া গেল, তাহাতে অসাধারণ যাহাদের মনীষা তাঁহারা হয়ত বুঝিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ ইহাতে কিছু বুঝিতে পাইল কি?
৩। স্রষ্টা কি সৃষ্ট হইতে ভিন্ন?
ঈশ্বর যদি তাঁহার সৃষ্ট পদার্থ হইতে ভিন্ন হন, তাহা হলে তাঁহার সর্বব্যাপিত্ব থাকিতে পারে না এবং ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্ব অক্ষুণ্ন থাকিলে কোন সৃষ্ট-পদার্থ এমন কি পদার্থের অণু-পরমাণুও ঈশ্বর-শূন্য হইতে পারে না। অর্থাৎ বিশ্বের যাবতীয় পদার্থই ঈশ্বরময়। মূল কথা — বিশ্ব ঈশ্বরময়, ঈশ্বর বিশ্বময়। ধর্ম যদিও ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্বে সন্দেহ করে না, কিন্তু একথাও নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে না যে, জগতের যাবতীয় জৈব-অজৈব পাক এবং নাপাক সকল বস্তুই ঈশ্বরে ভরপুর। বিশ্বাস যদি করিত, তবে নাপাক বস্তুকে ঘৃণা করিবার কারণ কি?
এখন এই উভয় সংকট হইতে ধর্মে বিশ্বাস বাঁচাইয়া রাখার উপায় কি?
৪। ঈশ্বর কি স্বেচ্ছাচারী না নিয়মতান্ত্রিক?
‘নিয়মতন্ত্র’ হইল কোন নির্ধারিত বিধান মানিয়া চলা এবং উহা উপেক্ষা করাই হইল ‘স্বেচ্ছাচারিতা’। ঈশ্বর স্বেচ্ছাচারী হইলে তাহার মহত্ত্বের লাঘব হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক হইলে তিনি তাঁর ভক্তদের অনুরোধ রক্ষা করেন কিরূপে? সুপারিশ রক্ষার অর্থই হইল, আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করা। অর্থাৎ স্বয়ং যাহা করিতেন না, তাহাই করা। ঈশ্বর কোন ব্যক্তি বিশেষের অনুরোধ বা সুপারিশে আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করিবেন না?
৫। আল্লাহ ন্যায়বান না দয়ালু?
অন্যান্য ক্ষেত্রে যাহাই হউক না কেন, বিচার-ক্ষেত্রে ‘ন্যায়’ ও ‘দয়া’-এর একত্র সমাবেশ অসম্ভব। কেননা দয়া করিলে ন্যায়কে উপেক্ষা করিতে হইবে এবং ন্যায়কে বজায় রাখিতে হইলে দয়া-মায়া বিসর্জন দিতে হইবে। বলা হয় যে, আল্লাহ্ ন্যায়বান এবং দয়ালু। ইহা কিরূপে সম্ভব? তবে কি তিনি কোন ক্ষেত্রে ন্যায়বান আর কেন ক্ষেত্রে দয়ালু?
৬। আল্লাহর অনিচ্ছায় কোন ঘটনা ঘটে কি?
বলা হয় যে, আল্লাহ্র অনিচ্ছায় কোন ঘটনা ঘটে না। এমনকি গাছের পাতাটিও নড়ে না। বিশেষত তাঁর অনিচ্ছায় যদি কোন ঘটনা ঘটতে পারে তাহা হইলে তাঁহার ‘সর্বশক্তিমান’ নামের সার্থকতা কোথায়? আর যদি আল্লাহর ইচ্ছায়ই সকল ঘটনা ঘটে তবে জীবের দোষ বা পাপ কি?
৭। নিরাকারের সাথে নিরাকারের পার্থক্য কি?
ম‘আল্লাহ্’ নিরাকার এবং জীবের ‘প্রাণ’ও নিরাকার। যদি উভয়ই নিরাকার হয়, তবে ‘আল্লাহ’ এবং ‘প্রাণ’ — এই দুইটি নিরাকারের মধ্যে পার্থক্য কি?
৮। নিরাকার পদার্থ দৃষ্টিগোচর হয় কিরূপে?
ধর্মযাজকদের নিকট শোনা যায় যে, বেহেস্তে বিশ্বাসীগণকে আল্লাহ (নূর ও আলোরূপে) দর্শন দান করিবেন। যিনি চির অনন্ত, চির অসীম, তিনি কি চির-নিরাকার নহেন? বিজ্ঞানীদের মতে — স্থূল অথবা সূক্ষ্ম, যে রূপেই হউক না কেন, কোন রকম পদার্থ না হইলে তাহা দৃষ্টিগোচর হয় না। আলো একটি পদার্থ। উহার গতি আছে এবং ওজনও আছে। নিরাকার আল্লাহ যদি তাঁর ভক্তদের মনোরঞ্জেনের জন্য নূর বা আলো রূপ গ্রহণ করিতে পারেন, তা হলে হিন্দুদের ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশে অর্থাৎ অবতারে দোষ কি?
৯। স্থান, কাল ও শক্তি — সৃষ্ট না অসৃষ্ট?
এ কথা সত্য যে, ‘সৃষ্টিকর্তা’ বলিয়া যদি কেহ থাকেন, তবে তিনি হইবেন এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু ধর্মজগতে তাঁহাকে চিত্রিত করা হইয়াছে বিবিধ রূপে এবং তাঁহার সংজ্ঞা ও সংখ্যা সব ক্ষেত্রে এক রকম নহে। বিশেষত ধর্মরাজ্যে তাঁহার পরিচয় পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রেই ‘ব্যক্তি’ রূপে। বলা হয় যে, ঈশ্বর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার; অথচ প্রত্যক্ষে না হইলেও পরোক্ষে তাঁহার চোখ, মুখ ও কান আছে — তাহার আভাস পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে। এমন কি তাঁহার পুত্র-কন্যা-পরিবারেরও বর্ণনা পাওয়া যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। সৃষ্টিকর্তা হইলেন — যিনি সৃষ্টি করেন বা করিয়াছেন। কোন সৃষ্ট পদার্থ স্রষ্টার চেয়ে বয়সে অধিক হইতে পারে না, এমন কি সমবয়সীও না। কোন কুমার একটি হাড়ি তৈয়ার করিল, এক্ষেত্রে হাড়ি কখনও কুমারের বয়োঃজ্যেষ্ঠ বা সমবয়সী হইতে পারে না। অর্থাৎ কর্তার আগে কর্ম অথবা কর্তা ও কর্ম একই মুহূর্তে জন্মিতে পারে না, ইহাই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম।
কোন পদার্থের সৃষ্টিকাল যতই অতীত বা মহাতীত হউক না কেন, উহা কখনও অনাদি হইতে পারে না। যাহা ‘সৃষ্টি’ তাহা নিশ্চয়ই কোন এক সময়ে উৎপত্তি হইয়া থাকিবে। কিন্তু বিশ্বে এমন কোন কোন বিষয় আছে, আমরা যাহার আদি, অন্ত, সীমা ও আকার কল্পনা করিতে পারি না। যেমন, স্থান, কাল ও শক্তি। বলা হইয়া থাকে যে, ঈশ্বর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। পক্ষান্তরে স্থান, কাল এবং শক্তিও অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। যথা ক্রমে এ বিষয় আলোচনা করিতেছি।
১. স্থান — বিশ্বের দৃশ্যাদৃশ্য যাবতীয় পদার্থই কোন না কোন স্থানে অবস্থিত আছে। ‘স্থান’ (Space) পদার্থপূর্ণ অথবা পদার্থশূন্য, দুইই থাকিতে পারে। কিন্তু ‘স্থান’কে থাকিতেই হইবে।
বিশ্বের যাবতীয় পদার্থই কোন না কোন সময়ে উৎপত্তি হইয়াছে। এমন কি পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে সৃষ্টির দিন-তারিখও দেওয়া আছে। সে যাহা হউক, কোন কিছু বা সব কিছু সৃষ্টির পূর্বে — পদার্থশূন্য থাকিলেও যে ‘স্থান’ ছিল না, তাহা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং বলিতে হয় যে, ‘স্থান অনাদি।‘
পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রাদি সৃষ্টি হইয়া কোন ‘স্থান’ এ অবস্থান করিতেছে এবং উহারা বিলয় হইলেও ঐ স্থান সমূহ থাকিবে। কেননা শূন্য স্থান কখনও বিলয় হইতে পারে না। সুতরাং বলিতে হয় যে ‘স্থান অনন্ত’।
পরম বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলিয়াছেন, “বিশ্ব অসীম অথচ সসীম।” অর্থাৎ নক্ষত্র-নিহারিকাদর পার্থিব জগত সসীম, কিন্তু ‘স্থান’ অসীম। বিশ্বের ‘শেষ প্রান্ত’ বলিয়া এমন কোন সীমারেখা কল্পনা করা যায় না, যাহার বহির্ভাগে আর ‘স্থান’ নাই। সুতরাং “স্থান অসীম”।
আমরা দেখিতে বা অনুভব করিতে পারি শুধু পদার্থকে, স্থানকে নয়। স্থান পদার্থের ন্যায় লাল, কালো, সবুজাদি রং এবং লম্বা-চওড়া ইত্যাদি আকৃতি বিশিষ্ট নয়। স্থানের কোন অবয়ব নাই। উহা আকৃতিহীন ও অদৃশ্য। অর্থাৎ নিরাকার।
২. কাল — কাল বা সময়কে আমরা দেখিতে পাই না, দেখিতে পাই শুধু ঘটনাকে। কেহ কেহ বলেন যে ‘কাল’ বা ‘সময়’ নামে কোন কিছু নাই, ‘কাল’ হইল ঘটনা পর্যায়ের ফাঁক মাত্র। সাধারণত কালকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করিয়া থাকি। যথা — ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান। কিন্তু কেহ কেহ বলে যে ‘বর্তমান’ নামে কোন কালই নাই। কেননা কাল সতত গতিশীল। যাহা গতিশীল তাহার স্থিরতা বা বর্তমানতা অসম্ভব। ভবিষ্যৎ হইতে কাল তীব্রগতিতে আসে এবং নিমেষে অতীতে চলিয়া যায়। এক সেকেণ্ডকে হাজার ভাগ করিলে যে সময়টুকু পাওয়া যায়, সেই সময়টুকু কাল দাঁড়াইয়া থাকে না ‘বর্তমান’ নামে আখ্যায়িত হইবার প্রত্যশায়। বর্তমান হইল — অতীত এবং ভবিষ্যতের সন্ধিস্থল মাত্র। উহার কোন বিন্দুতেই কাল এতটুকু স্থিত বা বর্তমান থাকে না। তবে আমরা যে বর্তমান যুগ, বর্তমান বৎসর, বর্তমান ঘটনা ইত্যাদি বলিয়া থাকি, উহা হইল অতীত এবং ভবিষ্যতের সংমিশ্রণ। যাক সে কথা।
ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করিয়াছেন কোন এক সময়ে। কিন্তু ‘সময়’ কে সৃষ্টি করিয়াছেন কোন সময়ে, তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। এরূপ কল্পনা করা মোটেই কষ্টকর নয় যে, এমন একটি সময় ছিল, যখন কোনরূপ সৃষ্টিই ছিল না। কিন্তু সৃষ্টির পূর্বে যে, ‘কাল’ ছিল না, তাহা কল্পনা করা যায় না। কাজেই বলিতে হয় যে, কাল ‘অনাদি’। পক্ষান্তরে — মহাপ্রলয়ে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হইবার পর — কাল আর থাকিবে না, তাহাও মানব কল্পনার বাহিরে। সুতরাং বলিতে হয় যে, কাল ‘অনন্ত’।
বিশ্বে, মহাবিশ্ব অথবা আরও বাহিরে এমন কোন জায়গা নাই, যেখানে কাল নাই। কালকে কোন স্থানে সীমিত রাখা যায় না। সুতরাং কাল ‘অসীম’। অধিকন্তু কাল ‘নিরাকার’ও বটে।
৩. শক্তি — ‘শক্তি’ বলিতে আমরা বুঝি যে, উহা কাজ করিবার ক্ষমতা। শক্তিকে জানিতে বেশী দূরে যাইতে হয় না। কেননা উহা আমাদের নিজেদের মধ্যেই আছে, যাহার সাহায্যে আমরা উঠা-বসা, চলা-ফেরা ও নানাবিধ কাজকর্ম করিয়া থাকি। কিন্তু শুধু গায়ের শক্তিতেই সকল রকম কাজ করা যায় না, অন্যান্য রকম শক্তিরও দারকার। গায়ের শক্তিতে কোন কিছু দেখা বা শোনা যায় না, গায়ে জোর থাকা সত্ত্বেও অন্ধ বা বধির ব্যক্তিরা দেখে না বা শোনে না, উহার জন্য চাই দর্শন ও শ্রবণ শক্তি। শুধু তাই নয়, আরও অনেক রকম শক্তি আমাদের দরকার এবং উহা আছেও। যেমন — বাকশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, স্পর্শশক্তি, ধীশক্তি, মননশক্তি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি জীবনীশক্তি। আমাদের দেহের মধ্যে যেমন রকম-রকম শক্তি আছে, তেমন প্রকৃতিরাজ্যেরও নানাবিধ শক্তি আছে; যেমন — তাপশক্তি, আলোকশক্তি, বিদুৎশক্তি, রাসায়নিক শক্তি ইত্যাদি।
বস্তুজগতে এমন কোন বস্তু নাই, যাহার মধ্যে কোনরূপ শক্তি নাই। সামান্য একটি দুর্বাপত্রেরও রোগ নিরাময় করিবাব শক্তি আছে। মূল কথা এই যে, এই জগৎটাই শক্তির লীলাখেলা। অর্থাৎ — শক্তি জগৎময় এবং জগৎ শক্তিময়।
বিজ্ঞানী প্রবর আইনস্টাইন বলিয়াছেন যে, ‘পদার্থ’ শক্তির রূপান্তর মাত্র। শক্তি সংহত হইয়া হয় পদার্থের উৎপত্তি এবং পদার্থের ধ্বংসে হয় শক্তির উদ্ভব। কি পরিমাণ শক্তির সংহতিতে কি পরিমাণ পদার্থ এবং কি পরিমাণ পদার্থ ধ্বংসে কি পরিমাণ শক্তির উদ্ভব হইতে পারে, তাহা তিনি অংকের সাহায্যে দেখাইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, একটি মটর পরিমাণ পদার্থকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করিতে পারিলে তাহা হইতে যে শক্তির উদ্ভব হইবে, তাহা দ্বারা বড় রকমের একখানা মালবাহী জাহাজ চালানো যাইবে লণ্ডন হইতে নিউইয়র্ক পর্যন্ত। আইনস্টাইনের এই সূত্র ধরিয়াই অধুনা হইয়াছে পারমাণবিক শক্তির আবিষ্কার। ইহাতে জানা যাইতেছে যে, এই জগতে জৈবাজৈব সমস্ত পদার্থই শক্তির রূপান্তর। অর্থাৎ জগতের সব কিছু সৃষ্টির মূলে রহিয়াছে ‘শক্তি’।
কোনরূপ কাজ করিতে হইলেই আগে চাই সেই কাজটি সমাধা করিবার মত শক্তি। অর্থাৎ শক্তি আগে ও কাজ পরে। এই জগত ঈশ্বর সৃষ্টি করিয়াছেন এবং সেই সৃষ্টিকাজেও তাঁর আবশ্যক হইয়াছিল শক্তির। যখন হইতে ঈশ্বর আছেন, তখন হইতে তাঁহার শক্তিও আছে। আমরা এমন একটা সময়কে কল্পনা করিতে পারি না, যখন ঈশ্বর ছিলেন অথচ তাঁহার শক্তি ছিল না। ঈশ্বর অনাদি। কাজেই শক্তিও ‘অনাদি’। পক্ষান্তরে আমরা এমন একটা সময়কে কল্পনা করিতে পারি না যখন কোনরূপ পদার্থ না থাকিলেও শক্তি থাকিবে না। কাজেই মানিতে হয় যে, ‘শক্তি অনন্ত’।
কোন পদার্থ বা পদার্থের অণুপরমাণুও যেমন শক্তিবিহীন নয়, তেমন সৌরজগত, নক্ষত্র বা নীহারিকাজগত অথবা তাহারও বহির্দেশের কোথায়ও শক্তি বিরল জায়গা নাই। শক্তি কোন স্থানে সীমিত নয়। অর্থাৎ ‘শক্তি অসীম’। তাপশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, চুম্বকশক্তি ইত্যাদি নানাবিধ শক্তির আমরা ক্রিয়া দেখিতেছি। কিন্তু কখনও শক্তিকে দেখিতে পাইতেছি না। আমরা প্রাণশক্তিবলে বাঁচিয়া আছি এবং নানা রূপ কর্ম করিতেছি। কিন্তু প্রাণশক্তিকে দেখিতে পাইতেছি না। কেননা, শক্তির কোন আকার নাই, ‘শক্তি নিরাকার’।
এ যাবত যে সমস্ত আলোচনা করা হইল, তাহাতে মনে হয় যে, ঈশ্বর যেমন অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার তেমন স্থান, কাল ও শক্তি — ইহারা সকলেই অনাদি, অনন্ত, অসীম এবং নিরাকার। এখন প্রশ্ন এই যে, ইহারা কি সৃষ্ট না অসৃষ্ট। অর্থাৎ ঈশ্বর কি ইহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন, না অনাদিকাল হইতে ইহারা স্বভাবতই বিদ্যমান আছে? যদি বলা হয় যে, ইহারা স্বাভাবতই বিদ্যমান আছে, তাহা হইলে ইহারা ঈশ্বরের সৃষ্টি নহে এবং যদি বলা হয় যে, ইহারা ঈশ্বরের সৃষ্টি — তবে পরমেশ্বর ‘স্থান’-কে সৃষ্টি করিলেন কোন স্থানে থাকিয়া, ‘কাল’-কে সৃষ্টি করিলেন কোন কালে এবং ‘শক্তি’-কে সৃষ্টি করিলেন কোন শক্তির দ্বারা?
১০। সৃষ্টি যুগের পূর্বে কোন যুগ?
ধর্মীয় মতে, হঠাৎ পরমেশ্বরের খেয়াল হইল যে, তিনি সৃষ্টি করিবেন জীব ও জগত। তিনি আদেশ দিলেন ‘হইয়া যাও’ — অমনি হইয়া গেল জগত এবং পশু-পাখি, গাছপালা, কীট-পতঙ্গ ও মানুষ্যাদি সবই। বিশ্বচরাচরের যাবতীয় সৃষ্টিকার্য শেষ হইতে সময় লাগিল মাত্র ছয়দিন।১ কিন্তু অনাদিকাল নিষ্ক্রিয় থাকিয়া পরমেশ্বর হঠাৎ সক্রিয় হইলেন কেন, ধর্মযাজকগণ তাহা ব্যাখ্যা করেন না। জীব ও জগতে সৃষ্টির পর হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়কে মানুষ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করিয়াছে। উহার এক এক ভাগকে বলা হয় এক-একটি যুগ । হিন্দু শাস্ত্র মতে যুগ চারিটি। যথা — সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। উহাদের ব্যাপ্তিকাল যথাক্রমে — সত্যযুগ ১৭,২৮,০০০, ত্রেতা যুগ ১২,৯৬,০০০, দ্বাপর ৮,৬৪,০০০, এবং কলি ৪,৩২,০০০ বৎসর। আলোচ্য যুগচতুষ্ঠয়ের মোট বয়সের পরিমাণ ৪৩,২০,০০০ বৎসর। কিন্তু কলি যুগটি শেষ হইতে এখনও প্রায় ৪,২৭,০০০ বৎসর বাকি।২ সুতরাং আলোচ্য যুগচতুষ্টয়ের অতীত বয়স মাত্র ৩৮,৯৩,০০০ বৎসর [ইহা বিজ্ঞানীদের সর্বাধুনিক প্লিস্টোসেন উপযুগটির সমানও নহে। এই উপযুগটির বর্তমান বয়স প্রায় ৫০ লক্ষ বৎসর]।
পবিত্র বাইবেল গ্রন্থের মতে জীব ও জগত সৃষ্টি হইয়াছে খৃ.পূ. ৪০০৪ সালে৩ এবং বর্তমানে খৃঃ ১৯৭২ । সুতরাং, এই মতে জগতের বর্তমান বয়স ৫৯৭৬ বৎসর। অর্থাৎ প্রায় ছয় হাজার বৎসর (ইহা হাস্যকররূপে অল্প)।
কাইপারাদি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৫০০ কোটি বৎসর পূর্বে আমাদের সূর্যের সৃষ্টি হইয়াছিল এবং তাহারও ৫০০ কোটি বৎসর পূর্বে সৃষ্টি হইয়াছিল আমাদের নক্ষত্র জগত। কোন কোন বিজ্ঞানীর মতে আমাদের পৃথিবীর বয়স ৪০০ কোটি বৎসর।৪
উক্ত চারিশত কোটি বৎসরকে বিজ্ঞানীগণ (ভুগর্ভস্থ স্তরসমূহের ক্রমানুসারে) কয়েকটি যুগ বা উপযুগে বিভক্ত করিয়াছেন। এখন হইতে ৫০ কোটি বৎসর পূর্বের যাবতীয় সময়কে একত্রে বলা হয় প্রাক ‘ক্যামব্রিয়ান মহাযুগ’ (Archaeo Zoic)। এই যুগের প্রথম দিকে পৃথিবীতে কোনরূপ জীব বা জীবনের অস্তিত্ব ছিল না। এই যুগটি অতিবাহিত হইয়াছিল - জ্বলন্ত পৃথিবী নির্বাপিত হইয়া তরল ও কঠিন হইতে এবং উত্তাপ কমিয়া জল-বায়ু সৃষ্টি হইয়া প্রাণীদের যুগ (Placo Zoic) ৩১ কোটি বৎসর, মধ্যজীবীয় যুগ বা সরীসৃপদের যুগ (Meso Zoic) ১২ কোটি বৎস ও নবজীবীয় যুগ বা স্তন্যপায়ীদের যুগ (Caino Zoic) ৭ কোটি বৎসর (এই যুগটি এখনও চলিতেছে)।৫
জীববিজ্ঞানীদের মতে, প্রাক ক্যামব্রিয়ান মহাযুগের শেষের দিকে পৃথিবীতে জীবন বা জীবের সূত্রপাত হইয়াছিল মাত্র এবং উহা ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ পাইয়াছে নবজীবীয় যুগে। এই যুগেই হইয়াছে পশু, পাখী, মানুষ ইত্যাদি উন্নত মানের জীবের আবির্ভাব।
আলোচ্য যাবতীয় যুগের ব্যাপ্তিকাল কোন মতে মাত্র ছয় হাজার বৎসর এবং কোন মতে এক হাজার কোটি বৎসর। ধর্ম বা বিজ্ঞান, যে কোন মতেই হউক না কেন, সৃষ্টির পর হইতেই যুগ গণনা করা হইয়া থাকে। তাই সামগ্রিকভাবে ইহাকে আমরা বলিতে পারি ‘সৃষ্টি-যুগ’। এই সৃষ্টি যুগেই দেখা যায় সৌরজগত, নক্ষত্রজগত ইত্যাদির পরিচালন এবং জীব জগতের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ-পোষণ ইত্যাদি পরমেশ্বরের যত সব কর্ম-তৎপরতা।
ঈশ্বর অনাদি এবং ‘কাল’ও অনাদি। কিন্তু যুগসমূহ অনাদি নয়, উহা সাময়িক। যখন হইতে ঈশ্বর আছেন, তখন হইতে কালও আছে। সেই ‘অনন্ত কাল’-এর সাথে কয়েক হাজার বা কোটি বৎসর সময়ের তুলনাই হয় না। এমন এক কাল নিশ্চয়ই ছিল যখন, কোনরূপ সৃষ্টিই ছিল না। সেই ‘অনাদি কালকে’ আমরা বলিতে পারি ‘অনাদি যুগ’ বা ‘অসৃষ্ট-যুগ’। সেই অনাদি-অসৃষ্ট যুগে পরমেশ্বর কি করিতেন?
১১। ঈশ্বর কি দয়াময়?
‘দয়া’ একটি মহৎ গুণ, এই গুণটির অধিকারীকে বলা হয় ‘দয়াবান’। মানুষ ‘দয়াবান’ হইতে পারে, কিন্তু ‘দয়াময়’ হইতে পারে না। কেননা মানুষ যতই ঐ গুণটির অধিকারী হউক না কেন, উহাতে পূর্ণতা লাভ করিতে পারে না। আর ঈশ্বর ঐ গুণে পূর্ণ, তাই তাঁহার একটি নাম ‘দয়াময়’।
কোন ব্যক্তি যদি একজন ক্ষুধার্থকে অন্নদান ও একজন পথিকের মাল লুণ্ঠন করে, একজন জলমগ্নকে উদ্ধার করে ও অন্য কাউকে হত্যা করে অথবা একজন গৃহহীনকে গৃহদান করে এবং অপরের গৃহ করে অগ্নিদাহ — তবে তাহাকে ‘দয়াময়’ বলা যায় কি? হয়ত ইহার উত্তর হইবে – ‘না’। কিন্তু উত্তরূপ কার্যকলাপ সত্ত্বেও ঈশ্বর আখ্যায়িত আছেন ‘দয়াময়’ নামে। এখন সে বিষয় কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাইতেছে।
জীবজগতে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন কোন সবল প্রাণী দুর্বল প্রাণীকে ধরিয়া ভক্ষণ করে, তখন ঈশ্বর খাদকের কাছে ‘দয়াময়’ বটে। কিন্তু তখন তিনি কি খাদ্য-প্রাণীর কাছেও দয়াময়? যখন একটি সর্প একটি ব্যাংকে ধরিয়া আস্তে আস্তে গিলিতে থাকে, তখন তিনি সর্পটির কাছে দায়ময় বটে। কিন্তু ব্যাঙটির কাছে তিনি নির্দয় নহেন কি? পক্ষান্তরে তিনি যদি ব্যাঙটির প্রতি সদয় হ’ন, তবে সর্পটি অনাহারে মারা যায় না কি? ঈশ্বর এক জীবকে অন্য জীবের খাদ্য নির্বাচন না করিয়া নির্জীব পদার্থ অর্থাৎ সোনা, রূপা, লোহা, তামা, মাটি, পাথর ইত্যাদি নির্বাচন করিতে পারিতেন কি না? না পারিলে কেঁচোর খাদ্য মাটি হইল কিরূপে? ঈশ্বরের সৃষ্টি জীবেরা সকলেই তাঁর দয়ার সমানাংশ প্রাপ্তির দাবীদার। কিন্তু তাহা পাইতেছে কি? খাদ্য সম্বন্ধে বলা যায় যে, ঈশ্বর মানুষের জন্য চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় ইত্যাদি অসংখ্য রকম খাদ্যের ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং পশু-পাখীদের জন্য বরাদ্দ করিয়াছেন ঘাস-বিচালী, পোকা-মাকড় আর কুকুরের জন্য বিষ্ঠা। ইহাকে ঈশ্বরের দয়ার সমবণ্টন বলা যায় কি?
কাহারও জীবন রক্ষা করা যদি দয়ার কাজ হয় এবং হত্যা করা হয় নির্দয়তার কাজ, তাহা হইলে খাদ্য-খাদক ব্যাপারে ঈশ্বর ‘সদয়’-এর চেয়ে ‘নির্দয়’-ই বেশী। তবে কতগুণ বেশী, তাহা তিনি ভিন্ন অন্য কেহ জানে না, কেননা তিনি এক একটি জীবের জীবন রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অসংখ্য জীবকে হত্যা করিয়া থাকেন। কে জানে একটি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য তিনি কয়টি মাছ, মোরগ, ছাগল ইত্যাদি হত্যা করেন? কে জানে তিনি একটি শোল, গজাল, বোয়াল মাছ এবং একটা বক পাখীর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে কয়টি চুনো মাছ হত্যা করেন? আমিষ ভোজী জীবদের প্রতি ঈশ্বরের এত অধিক দয়া কেন? তিনি কি হতভাগাদের ‘দয়াময়’ নহেন?
বলা হইয়া থাকে যে, মানুষ ঈশ্বরের সখের সৃষ্ট-জীব। তাই মানুষের উপর তাঁর দয়া-মায়াও বেশী। কিন্তু মানুষ ভেদে তাঁর দয়ার তারতম্য কেন? ঈশ্বর দয়া করিয়া সকল মানুষকেই প্রাণদান করিয়াছেন এবং দান করিয়াছেন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও সুখ-দুঃখের অনুভূতি সমান মাপে। অথচ মানুষের জীবিকা নির্বাহের কোন ব্যাপারেই ঈশ্বরের দয়ার সমবণ্টন নাই কেন? কেহ সুরম্য হর্মে বাস করে সাত তলায় এবং কেহ বা করে গাছ তলায়। কেহ পঞ্চামৃত (দুগ্ধ-দধি-ঘৃত-মধু-চিনি) আহার করে এবং কেহ জল ভাতে শুধু লবণ ও লঙ্কা পোড়া পায় না কেন? কেহ লম্ফ-ঝম্প ও দৌড় প্রতিযোগিতায় রেকর্ড করে, কেহ মল্ল যুদ্ধে পদক পায়। আবার অন্ধ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গেরা রাস্তায় বসিয়া অন্যের পায়ের আঘাত পায়। ঈশ্বরের দয়া বণ্টনে এরূপ পক্ষপাতিত্ব কেন? আর ‘ভাগ্য’ বলিয়া কিছু আছে কি-না? থাকিলে কাহারও ভাগ্যে চির শান্তি নাই কেন? ভাগ্যের নিয়ন্তা কে?
কাহারও জীবন রক্ষা করা দয়ার কাজ বটে, কিন্তু কাহাকেও বধ করা দয়ার কাজ নহে। বরং উহা দয়াহীনতার পরিচয়। জগতে জীবের বিশেষত মানুষের জন্মসংখ্যা যত, মৃত্যুসংখ্যা তত। সুতরাং জন্ম ও মৃত্যুর ব্যাপারে ঈশ্বর যেই পরিমাণ সদয়, সেই পরিমাণ নির্দয়, অর্থাৎ ঈশ্বরের সদয়তা ও নির্দয়তার পরিমাণ এক্ষেত্রে সমান।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কেহ কেহ মনে করেন যে, ঈশ্বর সদয়ও নহেন এবং নির্দয়ও নহেন। তিনি নিরাকার, নির্বিকার ও অনির্বচনীয় এক সত্তা। যদি তাহা নাই হয়, তবে পৃথিবীতে শিশু মৃত্যু, অপমৃত্যু, এবং ঝড়-বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প ইত্যাদিতে প্রাণহানিজনক ঘটনাগুলির জন্য তিনিই কি দায়ী নহেন?
টীকাসমূহ
১. পবিত্র কোরান (সুরা সেজদা) – আয়াত ১:৪
২. সরল বাংলা অভিধান, সুরলচন্দ্র মিত্র, পৃষ্ঠা. ৩০০
৩. মানব মনের আযাদি, আবুল হাসনাৎ, পৃষ্ঠা. ৬৭
৪. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ৪৪
৫. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১৫০, ১৫১
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1797#sthash.XUi5lZ1H.dpuf
০৪.তৃতীয়
প্রস্তাবঃ-
[পরকাল
বিষয়ক]১। জীব সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?
কেহ কেহ বলেন যে, মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য হইল আল্লাহ্র নাম ও গুণ কীর্তন করা। তাই যদি হয়, তাহা হইলে ইতর জীব সৃষ্টির কারণ কি? তাহারাও যদি ঐ পর্যায়ে পড়ে, তাহা হইলে তাহাদেরও বিচারান্তে স্বর্গ বা নরকবাসী হওয়া উচিত। কিন্তু তাহা হইবে কি? বলা হয় যে, মানুষ ও ইতর জীবের মধ্যে জ্ঞানের বৈষম্য আছে, তাই পরকালেও উহাদের মধ্যে বৈষম্য থাকিবে। বৈষম্য আছে বটে, কিন্তু একবারেই জ্ঞানহীন কোন জীব আছে কি? অতি ক্ষুদ্র পিপীলিকা হইতে অতি বৃহৎ হস্তী অবধি প্রত্যেকেই ন্যুনাধিক জ্ঞানের অধিকারী। কাক, শৃগাল, বানর, গরিলা, শিম্পাজী ইত্যাদির বুদ্ধিবৃত্তির নিকট সময় সময় সুচতুর মানুষও হার মানে এবং বোল্তা, ভীমরুল, মধুমক্ষিকা, উই পোকা ও বাবুই পাখীর গৃহ নির্মাণের কৌশলের কাছে মানুষের জ্ঞানগরিমা ম্লান হইয়া যায়। আবার মানুষের মধ্যেও এমন কতগুলি অসভ্য ও হাবা (বোকা) শ্রেণীর মানুষ দৃষ্ট হয়, যাহারা জ্ঞানের মাপকাঠিতে মনুষ্য পদবাচ্য নহে। তাহারা সৃষ্টি হইল কোন উদ্দেশ্যে?
২। পাপ-পুণ্যের ডায়রী কেন?
ধর্মযাজকগণ বলিয়া থাকেন যে, মানুষের পাপ-পুণ্য লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য প্রত্যেকটি মানুষের কাঁধে দুইজন করিয়া ফেরেস্তা বসিয়া আছেন। তাঁহারা আরও বলিয়া থাকেন যে, ঐ ফেরেস্তাদের রিপোর্ট অনুসারেই খোদাতা’লা মানুষের পাপ-পুণ্যের বিচার করিবেন। বলা হয় যে আল্লাহ্ সর্বদর্শী ও সর্বশক্তিমান। তবে মানুষের কৃত পাপ-পুণ্য তিনি কি নিজে দেখেন না? অথবা দেখিলেও মানুষের সংখ্যাধিক্যের জন্যই হউক অথবা সময়ের দীর্ঘতার জন্যই হউক, বিচার দিন পর্যন্ত উহা স্মরণ রাখিবার ক্ষমতা তাঁহার নাই কি?
৩। পরলোকের সুখ-দুঃখ শারীরিক, না আধ্যাত্মিক?
জীবের মৃত্যুর পর তার দেহটা রূপান্তরিত হইয়া পৃথিবীর কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থে পরিণত হয়। আবার ঐ সকল পদার্থের অণু-পরমাণুগুলি নানা উপায় গ্রহণ করিয়াই হয় নতুন জীবের দেহ গঠন। জীবদেহের ত্যাজ্য ময়লা। আবার মৃত্যুর পর আমার এই দেহের উপাদানে হইবে লক্ষ লক্ষ জীবের দেহ গঠন। মনে করা যাক — কোন এক অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ডাক্তারকে দিয়া একটি পাঁঠার দেহের প্রতিটি অণু বা কোষ (Cell) কোন উপায়ে চিহ্নিত করা হইল, যাহাতে যে কোন স্থান হইতে উহাদিগকে চিনিয়া বাহির করা যায়। এখন যদি ঐ পাঁঠাটি কোন এক ভোজ সভায় পাক করিয়া একশত লোককে ভোজন করান যায় এবং বাকি ত্যাজ্য অংশ — শৃগাল, কুকুর, কাক, শকুন, পিপীলিকা ইত্যাদিতে খাইয়া ফেলে তাহা হইলে কিছুকাল পরে ঐ পাঁঠাটির দেহটা পুনর্গঠন করিতে কতগুলি জীবদেহ কর্তন (Operation) করিতে হইবে? চিহ্নিত অংশগুলিকে চিনিয়া বাহির করিতে পারিলেও যতগুলি প্রাণী ঐ পাঁঠাটির দেহ ভক্ষণ করিয়াছিল ততগুলি প্রাণীর দেহ কর্তন না করিয়া কোন মতেই ঐ পাঁঠাটির দেহ পুনর্গঠন সম্ভব হইবে না। ইহাতে দেখা যাইতেছে যে, প্রাণী বিশেষের দেহ অন্যান্য বহু প্রাণীর দেহ হইতে আহৃত পদার্থ সমূহের সমষ্টির ফল। অর্থাৎ যে কোন একটি জীবের দেহ অন্যান্য বহু জীবের দেহ হইতে উদ্ভুত হইতেছে। এমতাবস্থায় পরকালে একই সময় যাবতীয় জীবের দেহে বর্তমান থাকা কি সম্ভব? যদি হয়, তবে প্রত্যেক দেহে তাহাদের পার্থিব দেহের সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যমান থাকিবে কিরূপে? যদি না থাকে, তবে স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ কি আধ্যাত্মিক?
স্বর্গ-নরকের সুখ-সুঃখ ও গোর-আজাব সম্বন্ধে যে সমস্ত বিবরণ শোনা যায়, তার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা চলে না। শোনা যায় যে, মৃত্যুর পরে শবদেহকে কবরের ভিতরে পুনর্জীবিত করা হয় এবং ‘মনকির’ ও ‘নকির’ নামক দুইজন ফেরেস্তা আসিয়া প্রত্যেক মৃতকে তার ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করে। যাহারা পাপী, তাহারা প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না বলিয়া তাহাদের উপর ঐ ফেরেস্তাদ্বয় অমানুষিক অত্যাচার চালায়। গুর্জের (গদার?) আঘাতে দেহ ৭০ গজ নীচে প্রোথিত হইয়া যায়। আবার তাহারা উহাকে পুনরোত্তলন করিয়া লয়। দোজখ হইতে সুরঙ্গপথে আগুণের উত্তাপ আসিয়া পাপী-দিগকে বিচারদিন পর্যন্ত জ্বালাইতে থাকে। অবশ্য পুণ্যবাণ ব্যক্তিগণ সুরঙ্গ পথে বেহেস্তের সুবাসিত মলয় বায়ু উপভোগ করিতে থাকেন।
দোজখের শাস্তির বর্ণনায় শোনা যায় যে, পাপীদিগকে পুঁজ, রক্ত, গরম পানি ইত্যাদি খাইতে দেওয়া হইবে, সূর্যের অত্যধিক উত্তাপে পাপীদের মস্কিষ্ক বিগলিত হইয়া যাইবে। চক্ষুর সাহায্যে পাপী যে পাপ করিয়াছে — যেমন যে পাপী পরস্ত্রী দর্শন করিয়াছে, তাহার চক্ষুকে শাস্তি দেওয়া হইবে। এইরূপ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদিও যাহাদের সাহায্যে কোন প্রকার পাপ করা হইয়াছে, সেই সমস্ত পাপের জন্য ঐ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শাস্তি হইয়া থাকিবে।
বেহেস্তের সুখের বর্ণনায় শোনা যায় যে, পুণ্যবানগণ নানা রকম সুমিষ্ট সুস্বাদু ফল আহার করিবেন, নেশাহীন মদিরা পান করিবেন, হুরীদের সহবাস লাভ করিবেন — এক কথায় প্রত্যেক পুণ্যবান ব্যক্তি মধ্যযুগের এক একজন সম্রাটের ন্যায় জীবন যাপন করিবেন।
ঐ সকল বর্ণনা হইতে বুঝা যায় যে, পারলৌকিক সুখ-দুঃখ ভোগ ও অন্যান্য কার্যকলাপ কোনটাই আধ্যাত্মিক অর্থে বর্ণিত হয় নাই, বরং দৈহিক রূপেই বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু ঐ সকল ব্যাপার সকলই যে দৈহিক, এ কথাও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চলে না। এই দুই প্রকার ব্যাখ্যার মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনটি?
৪। গোর আজাব কি ন্যায়সঙ্গত?
বলা হইয়া থাকে যে, খোদাতা’লাই একমাত্র পাপ-পুণ্যের বিচারক। মৃত্যুর পর সকল জীব বিচারদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে এবং প্রমাণাদি গ্রহণ পূর্বক বিচারের পরে পাপী দোজখে এবং পুণ্যবান বেহেস্তে যাইবে। কিন্তু একথাও বলা হইয়া থাকে যে, মৃতকে কবরস্থ করার পরই মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় আসিয়া নানারূপ প্রশ্ন করিবেন এবং সন্তোষজনক জবাব না পাইলে তাঁহারাই শাস্তি দেওয়া আরম্ভ করিবেন। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, পাপীদের প্রতি গোর আজাব কেন, খোদাই যদি পাপ-পুণ্যের বিচার করেন এবং বিচারের পরেই যদি পাপীর নরক এবং পুণ্যবানের স্বর্গসুখ ভোগ করিতে হয়, তবে বিচারের পূর্বে পাপী ও পুণ্যবান ন্যায়বিচারক আল্লাহর কাছে একই রকম ব্যবহার আশা করিতে পারে না কি? যদি বলা হয় যে, ঐ গোর আজাব ভোগ পাপীর পাপকর্মেরই ফল, খোদার হুকুমের শাস্তি, — তাহা হইলে বিচারদিনে বিচারের প্রহসন করার প্রয়োজন কি? আল্লাহ্ সর্বজ্ঞাতা। মৃত্যুর পর হইতেই তিনি পাপীকে নরক ও পুণ্যবানকে স্বর্গসুখ ভোগ করাইতে পারেন না কি? গোর আজাবের বর্ণনা করিলে বুঝা যায় যে, উহা একমাত্র ভূগর্ভেরই আজাব, ভূ-পৃষ্ঠের নহে। সচরাচর দেখা যায় যে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় বহুলোক মারা যায়, যাহাদের লাশ কবরস্থ হয় না। উহারা জলে-স্থলে ইতস্তত পড়িয়া থাকিয়া শিয়াল-কুকুর ও কাক-শকুনের ভক্ষ হয়। উহাদের গোর আজাব হয় না কি? হইলে কিরূপ হয়?
ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমানাদি (Semitic) জাতিরাই লাশ মাটিতে পুঁতিয়া রাখে, অন্যান্য জাতিরা ইহা করে না। তাহারা কেহ লাশ জলে ভাসাইয়া দেয়, কেহ মাঠে ফেলিয়া রাখে, কেহ পর্বতের চূড়ায় রাখিয়া দেয়, কেহ গাছের শাখায় ঝুলাইয়া রাখে এবং কেহবা আগুনে জ্বালাইয়া দেয়। এইভাবে যে সকল মানুষ পরজগতের যাত্রী হয়, তাহাদের গোর আজাব হয় না কি? যদি হয়, তবে কিরূপে? আর যদি না হয়, তবে লাশকে কবরে রাখিয়া লাভ কি?
কঠিন বা সহজ যেভাবেই হোক গোর আজাবের সময়সীমা লাশকে কবরস্থ করার পর হইতে কেয়ামত (মহাপ্রলয়) পর্যন্ত। মনে করা যাক যে, কোন একজন পাপী মরণান্তে লক্ষ বৎসর গোর আজাব ভোগের পর কেয়ামত হইল, অর্থাৎ সে ব্যক্তি একলক্ষ বৎসর গোর আজাব ভোগ করিল। আবার ঐ ব্যক্তির সমান পাপে আর এক ব্যক্তি মারা গেল কেয়ামতের দুই দিন পূর্বে। এ ক্ষেত্রে ঐ উভয় ব্যক্তির গোর আজাব ভোগের পরিমাণ সমান হইল কি?
৫। পরলোকের স্বরূপ কি?
‘পরকাল’ থাকিলে ‘পরলোক’ বা পরজগত নিশ্চয়ই থাকিবে কিন্তু পরকাল সম্বন্ধে দাবীটা যত অধিক জোরালো এবং পরিষ্কার, পরজগত বিষয়ে বিবরণটি তত অধিক ঘোরালো বা অস্পষ্ট। ইহজগতে মানুষের স্থিতিকাল নিতান্তই অল্প, বড় জোর ৬০, ৭০ কিংবা ১০০ বৎসর। মানুষ এই সামান্য সময়ের জন্য পৃথিবীতে বাস করিতে আসিয়া তার বহুমুখী জ্ঞানপিপাসা মিটাইবার জন্য আকাশ, পাতাল, সাগর, পাহাড় সর্বত্রই বিচরণ ও পর্যবেক্ষণ করিতেছে। এমন কি পদার্থের অণুকে দেখিয়া এখন পরমাণুকে ভাঙ্গিয়া তার শক্তি পরীক্ষা ও ব্যবহার করিতেছে। আর তাহার অনন্তকাল বাসের আবাস যে পরজগত, তাহা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা একান্তই ভাসা-ভাসা। ধর্মগুরুদের আধ্যাত্মিক পর্যটনের বিবরণ হইতে পরজগতের একটা ভৌগোলিক সংজ্ঞা প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাঁহাদের বিবরণ মতে পর জগত তিন ভাবে বিভক্ত। যথা — হাশর মাঠ, বেহেস্ত ও দোজখ। ইহারা পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। যেহেতু হাশরের মাঠ হইতে যাত্রা করিয়া দোজখে যাওয়া যায় এবং পোলছিরাত পার হইয়া বেহেস্তেও যাওয়া যায়। পৃথিবীতে ইহার একটি রূপক ব্যবহার করা যাইতে পারে। মনে করা যা’ক — আরব সাগর একটি অগ্নিসমুদ্র (দোজখ)। ইহার উপর দিয়া বোম্বাই হইতে এডেন পর্যন্ত একটি পুল আছে। এখন ভারতবর্ষ যদি হয় হাশরের মাঠ তাহা হইলে আরবদেশ হয় বেহেস্ত। অবস্থানটা এইরূপ নয় কি?
সে যাহা হউক, পরজগত যে কোন এক সৌরজগতের অধীন, তাহার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় হাশর মাঠের প্রাকৃতিক বর্ণনায়। কথিত হয় যে, হাশর ময়দানে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে পাপীদের মস্তিষ্ক বিগলিত হইবে এবং বেহেস্তে সুস্নিগ্ধ বায়ু প্রবাহিত হইবে। ইহাতে মনে হয় যে, হাশরের মাঠ ও দোজখ, সেখানের বিষুবীয় অঞ্চলে হইবে এবং বেহেস্ত হইবে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত।
পরজগতের আয়তন ইহজগতের তুলনায় কতগুণ বড় বা ছোট এবং হাশর মাঠের সীমা-চৌহদ্দি কি তাহা জানি না। তবে বেহেস্ত, দোজখ সীমিত। যেহেতু সংখ্যায় বেহেস্ত ৮টি এবং দোজখ ৭টি। যাহা সংখ্যা দ্বারা সূচিত হয়, তাহা সসীম হইতে বাধ্য। কেননা এক একটি বেহেস্ত বা দোজখ আয়তনে যত বিশালই হউক না কেন, একটির শেষ সীমা নির্ধারিত না হইলে আর একটির অবস্থান অসম্ভব কাজেই যে কোন একটির সীমা নির্ধারিত হইলে সব কয়টির সীমা যে নির্দিষ্ট, তাহা অনিবার্য। তাই প্রশ্ন হইতেছে যে, বেহেস্ত, দোজখ এবং হাশর মাঠের বর্হিভাগে কোন দেশ থাকিবে কি? থাকিলে সে দেশে কোন বাসিন্দা থাকিবে কি না?
শোনা যায় যে, পরলোকে সূর্য থাকিবে এবং সে উত্তাপ প্রদান করিবে। তবে কি আলো প্রদান করিবে না? যদি করে তাহা হইলে কি পরলোকেও দিনরাত্রি হইবে? যদি হয়, তবে তাহা কি রকম হইবে? অর্থাৎ সূর্য দৌড়াইবে, না ইহগজত বা পৃথিবীর মত পরজগতটা ঘুরিবে, না অনন্তকাল শুধু দিনই থাকিবে?
৬। ইহকাল ও পরকালে সাদৃশ্য কেন?
পরকালের অন্তর্গত কবর হাশর, বেহেস্ত, দোজখ ইত্যাদির যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায়, তার প্রত্যেকটি বর্ণনার বিষয়বস্তুই যেন এই পৃথিবীর বিষয়বস্তুর অনুকরণ বা সংস্করণ। যথা (কবরে) ছওয়াল বা প্রশ্ন, গুর্জ বা গদা, স্নিগ্ধ সমীরণ, উত্তপ্ত বায়ু প্রভৃতি; (হাশর ময়দানে) তামার পাত, সূর্যের তাপ, সাক্ষ্য জবানবন্দী, দাড়ি-পাল্লা, বিচার ইত্যাদি, (বেহেস্তে) সুমিষ্ট ও সুস্বাদু ফল, সুপেয় জল, দুধ, মধু, সুন্দরী রমণী ইত্যাদি এবং (দোজখে) অগ্নি, পুঁজ, রক্ত, গরম জল, পোল, সাঁড়াশী ইত্যাদি যাবতীয় পারলৌকিক বর্ণনা সমূহের আদ্যন্ত পর্যালোচনা করিলে মনে হয় যে, পরলোকের সবকিছুই যেন এই পৃথিবী হইতে গৃহীত, কিছুটা পরিবর্ধিত ও কিছুটা পরিবর্তিত। পরলোকে কি কিছুই অভিনব থাকিবে না?
৭। স্বর্গ-নরক কোথায়?
এক কবি বলিয়াছেন –
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেই সুরাসুর।
কবি কল্পিত ঐ স্বর্গ-নরক এই জগতেই। তবে উহা আধ্যাত্মিক, মানুষের মনোরাজ্যেই উহার অবস্থান। ইহা ভিন্ন পৃথিবীতে আর এক রকম স্বর্গের কথা শোনা যায়, উহা মানুষের শান্তির আবাস। হিন্দু শাস্ত্র আলোচনায় জানা যায় যে, স্বর্গ দেশটি দেব-দেবীগণের বাসস্থান। ওখানে চির বসন্ত বিরাজিত এবং শোক-তাপ, জরা-মৃত্যু কিছুই ওখানে নাই। ওখানে নন্দন কানন, পারিজাত বৃক্ষ, সুরভী গাভী, ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব প্রভৃতি সুখ সাধনের সামগ্রী সমস্তই বিদ্যমান আছে এবং স্বর্গবাসীদের কামনা-বাসনা মিটাইবার জন্য ওখানে অপ্সরা, কিন্নরী, গন্ধর্ব ইত্যাদি দেহবিলাসিনীও আছে।
উক্ত দেবপুরী বা স্বর্গদেশটি দুর্গম, দুরারোহ ও অতি উচ্চে অবস্থিত স্থান। হিন্দু মতে উহা সুমেরু পর্বতের উপরে অবস্থিত। বস্তুত উহা হিমালয় পর্বতের অংশ বিশেষ৬। অসাধারণ শারীরিক ও মানসিক শক্তি সম্পন্ন না হইলে এখানে কেহই পৌঁছিতে পারিত না। ওখান হইতে নীচু সমতল ভূমিকা বলা হইত ‘মর্ত্য’। সাধারণ মানুষ এই মর্ত্যলোকেই বাস করিত, শুধু দেবতারাই স্বর্গে ও মর্ত্যে যাতায়াত করিতে পারিতেন, সাধারণ মানুষ তাহা পারিত না।
মহাভারত পাঠে জানা যায়, যে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পদব্রজে সশরীরে স্বর্গে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁর স্বর্গ গমনের গতিপথ লক্ষ্য করিলে বুঝা যায় যে, ঐ স্বর্গটি কৈলাশপুরী ভিন্ন আর কোথায়ও নহে এবং হিমালয় পর্বতের একাংশে উহা অবস্থিত ছিল৭। ধর্মরাজ ওখানে পৌঁছিতে পারিয়াছিলেন, না পথেই মারা গিয়াছিলেন তাহা আমাদের জানা নাই। কিন্তু তৎপর বিখ্যাত পর্বতারোহী তেনজিং ও হিলারী বাদে বোধ হয় আর কোন মানুষ ওখানে যায় নাই।
মর্তবাসী মানুষের ওখানে যাতায়াত নাই বলিয়া দেবতারা ঐ স্বর্গে এখনও বাঁচিয়া আছেন, না মারা গিয়াছেন এবং ঐ স্বর্গটি আবাদী আছে, না জঙ্গলে পরিণত হইয়াছে — বর্তমানে তাহার কোন খবর নাই। ঐ স্বর্গটি বা স্বর্গীয় দেব-দেবীগণ বর্তমান থাকিলে ইদানীং পর্বতারোহীদের সামনে পড়িত।
রামায়ণ পাঠে জানা যায় যে, লঙ্কাধিপতি রাবণ মর্ত্য হইতে স্বর্গে আরোহণ করিয়া দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন এবং তাঁর পুত্র মেঘনাদ দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী করিয়া ‘ইন্দ্রজিৎ’ আখ্যা পাইয়াছিলেন। ইহাতে মনে হয় যে, যে কোন মর্ত্যবাসী গায়ের জোরেই ঐ স্বর্গে যাইতে পারিত। অতঃপর লঙ্কেশ্বর মর্ত্যবাসীগণ যাহাতে সহজে স্বর্গে উঠিতে পারে তাহার জন্য মর্ত্য হইতে স্বর্গ পর্যন্ত একটি সিঁড়ি তৈয়ার করিবার পরিকল্পনাও করিয়াছিলেন। কিন্তু রামের হাতে তাঁহার অকালমৃত্যু হওয়ায় উহা তিনি কার্যে পরিণত করিয়া যাইতে পারেন নাই। ইহাতে মনে হয় যে, রাবণরাজ দেবপুরী বা স্বর্গ অর্থাৎ হিমালয় পর্বতে আরোহণোপযোগী একটি সহজ পথ আবিষ্কারেরই পরিকল্পনা করিয়াছিলেন।
মুসলমানদের পুরান কাহিনী অনেক ক্ষেত্রে তৌরিত কেতাব তথা বাইবেলের অনুসারী। তবে কোন কোন স্থানে নামধামের সামান্য অদলবদল দেখা যায়। যেমন — ইভ = হাওয়া, সর্প = শয়তান, জ্ঞানবৃক্ষ = গন্ধম, এদন উদ্যান = বেহেস্ত ইত্যাদি।
তৌরিতে যে স্থানকে ‘এদন উদ্যান’ বলা ইহয়াছে, মুসলমানগণ ঐ স্থানকেই ‘বেহেস্ত’ এবং ঐ স্থানের ঘটনাবলীকেই বেহেস্তের ঘটনাবলী বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন।
হজরত আদমের আদিম বাসস্থান সম্বন্ধে তৌরিতের বিবরণটি এইরূপ — “আর সদাপ্রভু ঈশ্বর পূর্বদিকে এদনে এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন এবং সেই স্থানে আপনার নির্মিত ঐ মনুষ্যকে রাখিলেন। আর সদাপ্রভু ঈশ্বর ভূমি হইতে সর্ব জাতীয় সুদৃশ্য ও সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষ এবং সেই উদ্যানের মধ্যস্থানে ‘জীবন বৃক্ষ’ ও ‘সদসদজ্ঞানদায়ক বৃক্ষ’ উৎপন্ন করিলেন। আর উদ্যানে জলসেচনার্থে এদন হইতে এক নদী নির্গত হইল। উহা তথা হইতে বিভিন্ন হইয়া চতুর্মুখ হইল। প্রথম নদীর নাম পীশোন, ইহা সমস্ত হবিলাদেশ বেষ্টন করে, তথায় স্বর্ণ পাওয়া যায় আর সেই দেশের স্বর্ণ উত্তম। দ্বিতীয় নদীর নাম গীহোন, ইহা সমস্ত কুশদেশ বেষ্টন করে। তৃতীয় নদীর নাম হিদ্দেকল, ইহা অশূরিয়া দেশের সম্মুখ দিয়া প্রবাহিত হয়। চতুর্থ নদীর নাম ফরাৎ।”৮
তৌরিতের উক্ত বিবরণে দেখা যায় যে, পীশোন, গীহোন, হিদ্দেকল ও ফরাৎ এই নদী চারিটির উৎপত্তির এলাকার মধ্যে ঐ সময় ‘এদন’ নামে একটি জায়গা ছিল এবং ঐ এদনস্থিত একটি সুরম্য বাগানে আদমের বাসস্থান ছিল। ‘এদন’ জায়গাটি বোধ হয় যে, বর্তমান তুরস্ক দেশের পূর্বভাগে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তৌরিত গ্রন্থে লিখিত নদী চারিটি ঐ অঞ্চল হইতে উৎপন্ন হইয়া, পীশোন ও গীহোন নামক নদীদ্বয় কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে এবং হিদ্দেকল ও ফরাত নামক নদীদ্বয় একত্র হইয়া পারস্যোপসাগরে পতিত হইয়াছে। ঐ এদন উদ্যানে বাস করাকে বলা হয় ‘আদমের বেহেস্ত বাস’ এবং এদন উদ্যানকে বলা হয় ‘বেহেস্ত’।
বর্তমান কালের বহুল প্রচারিত ‘বেহেস্ত-দোজখ’ নাকি কোটি কোটি বৎসর পূর্বে সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত উহা ব্যবহার করা হয় নাই। শোনা যায় যে কেয়ামতের পর বিচারান্তে উহাতে লোক ভর্তি করা হইবে। আবার শোনা যায় যে, এস্রাফিল ফেরেস্তার সিঙ্গার ফুঁকে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড অর্থাৎ আল্লাহ্র যাবতীয় সৃষ্টিই লয় হইয়া যাইবে, স্বয়ং আল্লাহ ব্যতীত আর কিছুই থাকিবে না। তাহাই যদি হয় তবে বেহেস্ত-দোজখ লয় হইবে কিনা। যদি সঞ্চারের পূর্বেই উহা লয় হইয়া যায়, তবে কেয়ামতের পূর্বে আল্লাহ উহা সৃষ্টি করিলেন কেন, আর যদি না হয়, তবে উহা কি আল্লাহর সৃষ্টির বাহিরে অবস্থিত? অধিকন্তু কেয়ামতের পর বিচারান্তেই যদি উহাতে লোকভর্তি করা হয়, তবে এতাধিক কাল পূর্বে উহা সৃষ্টির সার্থকতা কি?
বহুপূর্বকালে পাশ্চাত্যের এক বড় শহরের নিকট একটি স্থানের নাম ছিল নাকি ‘গেহেন্না’। শহরের যাবতীয় ময়লা, রাশি রাশি আবর্জনা ও মৃত লাশ ওখানে ফেলিয়া জ্বালাইয়া দেওয়া হইত এবং অপরাধীগণকে ওখানে নিয়া নানারূপ শাস্তি দেওয়া হইত বা পোড়াইয়া মারা হইত। তৎকালীন লোকে ঐ জায়গাটাকে — নোংরা বলিয়া ঘৃণা ও বীভৎস বলিয়া অতিশয় ভয় করিত, কোন লোক ওখানে স্বেচ্ছায় যাইত না। বরং কোন ব্যক্তি কোনরূপ অসৎ কাজ করিলে লোকে তাহাকে এই বলিয়া শাসাইত যে, সে গেহেন্না যাইবে। অথবা বলিত “তুমি কি গেহেন্না যাইতে চাও?” ইত্যাদি।
উক্ত ‘গেহেন্না’ শব্দটি ভাষান্তরে — গেহেন্নাম জেহেন্নাম (ইংরেজী g অক্ষরটির ‘জ’ উচ্চারণ) এবং আরবী ভাষায় উহা হইয়াছে নাকি ‘জাহান্নাম’।
বৈদিক মতে, স্বর্গকে মনে করা হয় অতিউচ্চে বা ঊর্ধ্বে অবিস্থত স্থান। তাই স্বর্গের এক নাম “ঊর্ধ্বলোক”। আবার ক্বচিৎ ইহার বিপরীত মতও শোনা যায়। কোন কোন ধর্মযাজক বলেন যে, পুণ্যবানদের কবরের সঙ্গে বেহেস্তের এবং পাপীদের কবরের সঙ্গে দোজখের (সুরঙ্গপথে) যোগাযোগ হয়। ইহাতে মনে হয় যে, বেহেস্ত-দোজখ ভূগর্ভেই অবস্থিত আছে। বাস্তবিকই কি তাহাই?
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, ভূ-পৃষ্ঠের গড় উত্তাপ ২০০ সেন্টিগ্রেড বা ৬৮০ ফারেনহাইট এবং ৩০ মাইল নিম্নের তাপমাত্রা ১২০০০ সে. বা ২২০০০ ফা.। এই উত্তাপে অনায়াসে পাথরাদি গলিয়া যাইতে পারে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ও লাভাক্ষরণ সেখান হইতেই হইয়া থাকে। নিম্ন দিকে ক্রমশ উত্তাপ বৃদ্ধি পাইয়া কেন্দ্রের দিকে তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৬০০০০ সে.৯। ইহা সূর্যের বহিরাবরণের তাপের সমান। ইহাতে বুঝা যায় যে, ভূ-গর্ভে নরকাগ্নি থাকা অসম্ভব নহে। কিন্তু স্বর্গীয় উদ্যান সমূহ কোন্ জায়গায়?
স্বর্গ ও নরকের-আধ্যাত্মিক, পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক বিবরণ যাহাই হউক, বর্তমানে উহার যে কল্পচিত্র দেখানো হয়, তাহার কোনরূপ ভৌগোলিক সত্তা আছে কি?
টীকাসমূহ
৬. সরল বাংলা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্র, পৃষ্ঠা. ৮৭২
৭. সরল বাংলা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্র, পৃষ্ঠা. ২৫১
৮. আদিপুস্তক (তৌরীত), ২:৪, পৃষ্ঠা. ১৪
৯. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১০২
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1798#sthash.6jGxn4Fu.dpuf
০৫.চতুর্থ প্রস্তাবঃ-
[ধর্ম বিষয়ক]
১। আল্লাহ মানুষকে পরিবর্তন না করিয়া ঝঞ্ঝাট পোহান কেন?
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি ইচ্ছা করিলে অসম্ভবও সম্ভব করিতে পারেন। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যদি ইহাই হয় যে, মানুষ তাঁহার এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহা হইলে তিনি সমস্ত মানবকে দিয়া তাঁহার উদ্দেশ্য পালন করাইতে পারেন না কি? পারিলে তাহা না করিয়া তিনি মানুষের দ্বারা হেদায়েতের ঝঞ্ঝাট পোহান কেন? ইহাতে কি তাঁহার আসল উদ্দেশ্যের ব্যাঘাত ঘটিতেছে না? হযরত ইব্রাহিম, মুসা, ও মোহাম্মদ (দ.)-কে কোন মানুষ হেদায়েত করে নাই, করিয়াছেন আল্লাহতায়ালা। কিন্তু নমরুদ, শাদ্দাদ, ফেরাউন, আবু জাহেল ইত্যাদি কাফেরদিগকে তিনি হেদায়েত করিলেন না কেন? তিনি স্বেচ্ছায় হেদায়েত করিলেন না, না, করিতে পারিলেন না?
২। ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়?
যদিও মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ, তবু কর্মফলে বিশ্বাস আছে বলিয়াই সে জগতের সকল রকম কাজকর্ম করিয়া যাইতেছে্ সমাজ ও রাষ্ট্র কর্মফলকে ভিত্তি করিয়াই গঠিত হইয়াছে এবং ‘কর্মফল আছে’ বলিয়াই উহারা টিকিয়া আছে। রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে শিক্ষা দিতেছে – কর্ম কর, ফল পাইবে। কিন্তু ধর্ম শিক্ষা দিতেছে ইহার বিপরীত। ধর্ম বলিতেছে – কর্ম করিয়া যাও, ফল অদৃষ্টে (তকদীরে) যাহা লিখিত আছে, তাহাই পাইবে। এক্ষেত্রে মানুষ কর্ম করিল বটে, কিন্তু ফল রহিল ভগবানের কাছে ভাগ্যলিপিতে নিবদ্ধ। মানুষ জানিল না যে, সে তাহার কাজের ফল পাইবে কি না। কর্মফলের নিশ্চয়তা থাকিলে সন্দিগ্ধ মনেও কাজ করা চলে। যেহেতু তাহাতে মানুষ ভাবিতে পারে যে, হয়ত সে তাহার কাজের ফল পাইতেও পারে। কিন্তু ধর্ম বলে – কর্ম যা কিছুই কর না কেন, ফল নির্ধারিত যাহা আছে, তাহাই পাইবে, একটুও এদিক ওদিক হইবে না। তাহই যদি হয়, অর্থাৎ কর্মের দ্বারা ভাগ্যলিপি পরিবর্তিত না হয়, তবে কর্ম করিয়া লাভ কি? বিশেষত মানুষের কৃত ‘কর্মের দ্বারা ফলোৎপন্ন’ না হইয়া যদি ঈশ্বরের নির্ধারিত ‘ফলের দ্বারা কর্মোৎপত্তি’ হয়, তবে ‘সৎ’ বা ‘অসৎ’ কাজের জন্য মানুষ দায়ী হইবে কেন? মনে করা যাক – কোন এক ব্যক্তির ভাগ্যলিপিতে লেখা আছে যে, সে ‘নারকী’। এখন সে নির্ধারিত ঐ ফলোৎপাদক কার্য, যথা – চুরি, ডাকাতি, নরহত্যা ইত্যাদি করিবে না কি? যদি করে, তবে তাহা সে কাহার ইচ্ছায় করে? নিজের ইচ্ছায়, না ভগবানের ইচ্ছায়? আর যদি সে কোন পাপ-কর্ম না করিয়া পুণ্য কর্মই করে, তবে তাহার ভাগ্যলিপির ‘নারকী’ শব্দটি কাটিয়া, স্বর্গবাসী এই শব্দটি লেখা হইবে কি? যদি না-ই হয়, তবে হেদায়েতের তম্বিটি কি লৌকিক? আর যদি হয়, তবে ভবিষ্যৎজান্তা ভগবান এই পরিবর্তনের সংবাদ পূর্বাহ্নে জানিয়া প্রথমবারেই অকাট্য তালিকা প্রস্তুত করেন নাই কেন?
ভাগ্যলিপি অপরিবর্তনীয় হইলে স্বয়ং ভগবানও উহা মানেন কি না। যদি না মানেন, তবে তিনি উহা লিখিয়াছিলেন কেন? আর যদি মানেন, তবে তিনি লিপি প্রস্তুতির সময় স্বাধীন হইলেও বর্তমানে স্বাধীন হন কিরূপে? ভগবানের বর্তমান কর্তব্য কি শুধু তালিকা দেখিয়া দেখিয়া জীবকুলকে দিয়ে কার্য করান? তাহাই যদি হয়, তবে বিশ্বস্রষ্টার আশু কর্তব্য কিছুই নাই?
৩। আদমের পাপ কি?
আলেমগণ বলিয়া থাকেন যে, আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য হইল এই যে, আল্লাহ তাঁহার দ্বারা পৃথিবী মানুষপূর্ণ করিবেন এবং শেষপয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (দ.)-এর দ্বারা ইসলাম প্রচার করাইবেন ইত্যাদি। এই সমস্ত পরিকল্পনাই নাকি ভাগ্যলিপির অন্তর্ভুক্ত। আদমকে বেহেস্তে রাখিয়া তাঁহাকে গন্দম খাইতে যে নিষেধ করা হইয়াছিল, সে নিষেধ কি খোদাতা’লার আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল? আদম গন্দম খাইয়া প্রকারান্তরে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ করিলেন। যে কাজ ভাগ্যলিপির অনুকূল এবং আল্লাহর ইচ্ছাকে পূর্ণ করে, তাহাতে পাপ কি? পক্ষান্তরে আদম যদি গন্দম না খাইতেন, তাহা হইলে মাহফুজের (লিপিফলকের) যাবতীয় লিপিই বরবাদ হইত না কি? অর্থাৎ পৃথিবীতে মানবসৃষ্টি, বেহেস্ত, দোযখ, হাশর ময়দান ইত্যাদির পরিকল্পনা সমস্তই মাঠে মারা যাইত না কি?
৪। শয়তান কি?
শয়তানের সহিত কোন মানুষের প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকিলেও তাহার নামটির সাথে যথেষ্ট পরিচয় আছে। ‘শয়তান’ – এই নামটি এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইতেছে যে, হাটে, মাঠে, কোর্ট-কাছারীতে, দোকান, স্কুল-কলেজ, ওয়াজের মাহফিল ইত্যাদির সবর্ত্র এবং নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, এমনকি অনেক হিন্দুও ‘শয়তান’ নামটি ব্যবহার করিয়া থাকেন। কেহ, কেহ, এমনও বলিয়া থাকেন যে, “ব্যাটা ভারী শয়তান”। ‘শয়তান’ কথাটির ধাতুগত অর্থ যাহাই হউক, উহাকে সমাজের যাবতীয় দুষ্কর্মের কারক হিসাবেই লোক ব্যবহার করিতেছে।
ধর্মাধ্যায়ীগণ বলিয়া থাকেন যে, শয়তান পূর্বে ছিল ‘মকরম’ বা ‘ইবলিস’ নামক বেহেস্তবাসী একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেস্তা এবং অতিরিক্ত মুসল্লি। মকরম সেখানে খোদাতালার হুকুমমত আদমকে সেজদা না করায় ‘শয়তান’ আখ্যা পাইয়া চিরকাল মানুষকে অসৎ কাজের প্ররোচনা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়া পৃথিবীতে আসে এবং সে অদ্যাবধি নানাবিধ উপায়ে অসৎ কাজে প্ররোচনা বা দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।
আদম ও বিবি হাওয়াকে দাগা দিয়াছিল শয়তান একা। কিন্তু আদমের বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শয়তানেও কি বংশবৃদ্ধি হইতেছে? না হইলে দাগাকাজ সুচারুরূপে চলে কি রকম?
কেহ কেহ বলেন যে, শয়তানেও বংশবৃদ্ধি হয় এবং উহা মানুষের চেয়ে দশগুণ বেশী। কারণ প্রতিগর্ভে সাধারণত মানুষ জন্মে একটি, আর শয়তান জন্মে দশটি করিয়া। তাহাদের নাম হয় যথাক্রমে – জ্বলিতন, ওয়াছিন, নফছ, আওয়াম, আফাফ, মকার, মহুদ, দাহেম, ওল-হান ও বার্ ইহারা ক্ষেত্রবিশেষে থাকিয়া বিশেষ বিশেষ দাগাকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। অধিকন্তু ইহাদের মানুষের মত মরণ নাই। কেয়ামতের দিন মানবজাতি যখন কায় পাইবে তখন ইহাদের মৃত্যু ঘটিবে।
জন্ম-মৃত্যুর ঠেকাঠুকিতেও বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ টিকিয়া আছে প্রায় তিনশ কোটি। আর মানুষের চেয়ে দশগুন বৃদ্ধি পাইয়া শয়তানের সংখ্যা কত? আদম হইতে আজ পর্যন্ত যত লোক জন্মিয়াছে তাহারা যদি সকলেই জীবিত থাকিত, তাহা হইলে লোকসংখ্যা যত হইত, বোধ হয় যে, কোন ভাষার সংখ্যা দ্বারা তাহা প্রকাশ করা যাইত না। পৃথিবীতে বর্তমানে শয়তানের সংখ্যা তাহারই দশগুণ বেশী নয় কি? ইহাতে মনে হয় যে, পৃথিবীর জলে, স্হলে ও বায়ুমন্ডলে শয়তান গিজগিজ করিতেছে এবং প্রতিটি মানুষের পিছনে লাখ লাখ শয়তান দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।
এত অসংখ্য শয়তান মানবসমাজকে পাপের পথে অহরহ প্ররোচিত করিতেছে, কিন্তু শয়তানের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাইলেও অসৎকাজের মাত্রা ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে না, বরং মানবিক জ্ঞান ও সভ্যতা বৃদ্ধিরর সাথে সাথে অসৎকাজের মাত্রা ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। এখনও দেখা যায় যে, শিক্ষিতের সংখ্যা ও শিক্ষায়তনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িতেছে বৈ কমিতেছে না। ন্যায়নিষ্ঠ সাধুপুরুষদের সংখ্যাও নগণ্য নহে। লন্ডন শহরে নাকি এমন দোকানও আছে, যেখানে বিক্রেতা নাই। অথচ ক্রেতাগণ উচিত মূল্য দিয়াই জিনিসপত্র ক্রয় করিতেছে। আবার কোন রকম হারান জিনিস প্রাপ্ত হইয়াও কেহ তাহা আত্মসাৎ করে না। বরং লন্ডন ট্রান্সপোর্ট লস্ট প্রপার্টি অফিসে উহা জমা দিয়া থাকে, সেখান হইতে জিনিসের মালিক তাহা ফেরত পাইয়া থাকে।১০ সেখানে কি শয়তান কম?
ধর্মপ্রচারকদের বর্ণনা শুনিয়া মনে হয় যে, ফেরেস্তাগণ সবাই নপুংসক। মকরমও তাহাই ছিল ‘লানত’ বা অভিশাপ প্রাপ্তির সময়ও মকরম একাই ছিল এবং নপুংসক ছিল। তৎপর তাহার বংশবৃদ্ধির জন্য লিঙ্গভেদ হইল কখন? শুধু ইহাই নহে, শয়তানের বংশবৃদ্ধি সত্য হইলে, প্রথমত তাহার ক্লীবত্ব ঘুচাইয়া পুংলিঙ্গ গঠনাস্তে একটি স্ত্রী-শয়তানেরও আবশ্যক ছিল। বাস্তবিক কি শয়তানেও স্ত্রী আছে/ আর না থাকিলে্ই বা তাহার বংশবৃদ্ধির উপায় কি?
‘শয়তানের দাগা’ বলিতে কি শুধু রোজা-নামাজের শৈথিল্যই বুঝায়, না চুরি, ডাকাতি, বদমায়েশী, নরহত্যা ইত্যাদিও বুঝায়? যদি যাবতীয় অসৎকার্য শয়তান কর্তৃকই অনুষ্ঠিত হয়, তবে জাতিভেদে অসৎ কাজের মাত্রাভেদ হয় কেন? অর্থাৎ, যে কোন দেশের সম্প্রদায়সমূহের জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধী বা কারাবাসীর সংখ্যা হওয়া উচিত। কিন্তু তাহা না হইয়া সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের মধ্যে কারাবাসীর সংখ্যাধিক্য কেন?
জীবজগতে দেখা যায় যে, মাংসাশীগণ উগ্রস্বভাববিশিষ্ট এবং নিরামিষাশীরা শান্ত। গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, হাঁস-মোরগ, কবুতর, ইত্যাদি প্রাণী মাংসাশী নহে, ইহারা শান্ত। অথচ ব্যাঘ্র, সিংহ, শৃগাল, কুকুর, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণীকূল মাংসাশী এবং উগ্রস্বভাববিশিষ্ট। এ কথাও স্বীকার্য যে, স্বভাবের উগ্রতায় নানা প্রকার অঘটন ঘটিয়া থাকে। ইহাও দেখা যায় যে, মানব সমাজের ভিতর যে জাতি অতিরিক্ত মাংসাশী, সেই জাতির মধ্যেই অতিরিক্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নরহত্যা অনুষ্ঠিত হয়। এই সকল গর্হিত কাজের উৎপাদক কি শয়তান, না মাংস আর উত্তেজক মসল্লা?
বলা যাইতে পারে যে, কোন কোন দেশের মানুষ মাংসাশী হইয়াও বেশ শান্ত-শিষ্ট ও সংযমী। ইহার কারণ এই নয় যে, সে দেশে শয়তানের উপদ্রব কম বা সে দেশের মাংসে উত্তেজনাশক্তি নাই। ইহার কারণ এই যে, এইরুপ কোন জাতি নিরক্ষাঞ্চলের অধিবাসী নহে। অধিকাংশই হিমাঞ্চলের বাসিন্দা। দেশের শীতকালই তাহাদের স্বভাবের উগ্রতা প্রশমিত করিয়া রাখে।
সুধীগণ বলেন যে, মানুষের মধ্যে ছয়টি আধ্যাতিক শত্রু আছে। উহারা ষড়রিপু নামে পরিচিত। যথা == কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। ইহাদের তাড়নায় মানুষ নানাবিধ অসৎকাজ করিয়া থাকে। যে কোন উপায়ে হউক, ইহাদিগকে দমন করিতে পরিলে মানুষ নিষ্পাপ হইতে পারে।
মানোবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সভ্যতার ঊষালোক পইবার পূর্বে আহার-বিহারে মানুষ ও ইতর জীবের মনোবৃত্তির বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সে সময়ের মানুষের মন ছিল কৃত্রিমতাহীন, সরল ও স্বাধীন। তখন মানুষ তাহার যে কোন ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে পারিত। তখন প্রবৃত্তিই ছিল মানুষের যথাসর্বস্ব। জ্ঞান উন্মেষের সাথে সাথে মানুষ প্রথম দলবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে শুরু করে। এই দল বা সমাজকে রক্ষা করিতে আবশ্যক হইল ত্যাগ ও সংযমের। আদিতে এই ত্যাগ ও সংযম ছিল স্বেচ্ছাধীন। ক্রমে যখন সভ্যতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, তখন তাহার দল বা সমাজের বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সংযমকে বাঁধিল নীতি ও নিয়মের শৃঙ্খলে। ইহাতে মানুষের সেই স্বাধিন প্রবৃত্তিগলিকে সু ও কু – এই দুইভাগে বিভক্ত করিয়া সু প্রবৃত্তিগুলিকে স্বাধীনই রাখা হইল, কিন্তু কু প্রবৃত্তিগুলিকে করা হইল কারারুদ্ধ। কারাবাসী কুপ্রবৃত্তিগুলিকে মনের অন্ধকার কারাকক্ষে ঘুমাইয়া রহিল। মনের যে অংশে সেই রুদ্ধপ্রবৃত্তি বাস করে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাহাকে বলা হয় অচেতন মন বা নির্জ্ঞান মন (Unconscious Mind)।
মানুষ তাহার জাতিগত জীবনের হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন অচেতন মন স্বরুপ মূলধন (উত্তরাধিকার সূত্রে) লইয়া প্রথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ যে সকল অশুভ কামনা সমাজের নীতি, ধর্মের বিধান ও রাষ্ট্রের শাসনের ভয়ে চরিতার্থ করিতে পারে না, তাহাও ক্রমে বিস্মৃতির অতুলগর্ভে ডুবিয়া গিয়া অচেতন মনে স্হান লয়। অচেতন মনে রুদ্ধপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলিকে যে শক্তি অবরুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহাকে কারারক্ষী (Censor) বলা হয়। কারাবন্দী কুপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলির সহিত মেলামেশা করিয়া তাহাদিগকে বিপথে চালিত করে। ইহা হইতে মানব সমাজের যত কিছু বিড়ম্বনা। মানুষের যাবতীয় অশুভচিন্তা ও অসৎকাজের উদ্যোক্তা এই অচেতন মন।
এতদ্বিষয পর্যালোচনা করিলে বুঝা যায় যে, যাবতীয় অসৎকাজের উদ্যোক্তা মানুষের অভ্যন্তরীণ রিপুসমূহ, বাহিরের কিছু নয়। তবে কি মানুষের কু-প্রবৃত্তিগুলিকেই শয়তান বলা হয়, না মানবদেহাতিরিক্ত স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট শয়তান-এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়?
৫। উপাসনার সময় নির্দিষ্ট কেন?
দেখা যায় যে, সকল ধর্মেই কোন কোন উপাসনার জন্য বিশেষ বিশেষ সময় নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ঐ সকল উপাসনা করিলে বিশ্বপতি কে উহা মন্জুর করিবেন না, তাহার কোন হেতু পাওয়া যায় না। ইসলামিক শাস্ত্রে প্রত্যেহ পাঁচবার নামাজের ব্যবস্হা আছে। এই পাঁচবার নামাজের প্রত্যেকবারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আদেশ আছে, আবার কোন কোন সময়ে নামাজ নিষেধ।
পৃথিবী আবর্তনের ফলে যে কোন স্হিরমুহূর্তে বিভিন্ন দ্রাঘিমার উপর বিভিন্ন সময় সূচিত হয় এবং প্রতি মুহূর্তেই কোন না কোন স্হানে নির্দেশিত উপাসনা চলিতে থাকে। অথচ সূর্য উদয়, সূর্য অস্ত এবং মধ্যাহ্নে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ (হারাম)। ইহার তাৎপর্য কি? এখানে যখন সূর্যোদয় হইয়াছে, তখন এখান হইতে পশ্চিমে কোনখানে সূর্যোদয় নাই এবং এস্হান হইতে পূর্বদিকে পুর্বেই সূর্যোদয় হইয়াছে। এখানে যখন নামাজ পড়া হারাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই অন্যত্র হারাম নহে। উদাহারণস্বরুপ বলা যাইতে পারে যে, বরিশালে যখন সূর্যোদয় হইতেছে, তখল কলিকাতায় হয় নাই এবং চট্টগ্রামে কিছু পূর্বেই সূর্যোদয় হইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ বরিশালে যখন নামাজ পড়া হারাম, তখন কলিকাতা বা চট্টগ্রামে হারাম নহে। তাহা হইলে নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা নিষিদ্ধ হওয়ার তাৎপর্য কিছু আছে কি?
নামাজের নিষিদ্ধ সময় সম্বন্ধে যে কথা, ওয়াক্ত সম্বন্ধে সেই একই কথা। পৃথিবীর কোনস্হানেই ওয়াক্ত নহে – এরুপ কোন স্হির মুহূর্ত আছে কি? যদি না থাকে, অর্থাৎ, প্রতি মুহূর্তেই যদি পৃথিবীর কোন না কোন স্হানে নামাজ পড়া চলিতে থাকে, তবে নামাজের সময় নির্ধারণের তাৎপর্য কি?
একসময় পৃথিবীকে স্হির ও সমতল মনে করা হইত। তাই পৃথিবীর সকল দেশে বা সকল জায়গায় একই রকম সময় সূচিত হইবে, বোধহয় যে এরূপ মনে করিয়া ঐসকল বিধি-নিষেধ প্রবর্তিত হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পৃথিবী গোল ও স্হিতিশীল।
পৃথিবীর গোলকহেতু যে কোন স্হানে বিশেষত সাগর বা মরূভূমিতে দাঁড়াইয়া দৃষ্টিপাত করিলে নিজেকে ভূ-পৃষ্ঠের কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভ্রম হয়। মনে হয় যে, এই কারণেই আরববাসীগণ পবিত্র মক্কা শহরকে পৃথিবীর (ভূ-পৃষ্ঠের) কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভাবিতেন এবং ওখানের সকাল-সন্ধাকেই ‘সকল দেশের সকাল-সন্ধা’ বলিয়া মনে করিতেন। এই ভ্রমাত্মক ধারণার ফলে যে সকল সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে, তাহার কিছু আলোচনা করা যাক।
মনে করা যাক – কোন ব্যক্তি বেলা দেড়টার সময় জোহর নামাজ আদায় করিয়া বিমান-যোগে প্রতি ঘন্টায় তিন হাজার মাইল বেগে চট্টগ্রাম হইতে পবিত্র মক্কা যাত্রা করিলেন। সেখানে পৌঁছিয়া তিনি দেখেন যে, ওখানে তখন দুপুর হয় নাই। ওয়াক্ত হইলে ঐ ব্যক্তির আর একবার জোহর নামাজ পড়িতে হইবে কি?
প্রতি ঘন্টায় ১০৪১২/৩ মাইল বেগে পশ্চিম দিকে বিমান চালাইলে (আপাতদৃষ্টিতে) সূর্যকে গতিহীন বলিয়া দেখা যাইবে। অর্থাৎ আরোহীর কাছে প্রাত:, সন্ধ্যা ও মধ্যাহ্ন কিছুই হইবে না; সূর্য যেন স্হিরভাবে একস্হানে দাঁড়াইয়া থাকিবে। এমতাবস্হায় আরোহীদের নামাজ ও রোজার উপায় কি?
পৃথিবীর শুধু বিষুব অঞ্চলেই বৎসরের কোন কোন সময় দিন ও রাত্রির পরিমাণ প্রায় সমান হয় না, ব্যবধান অল্প থাকে। কিন্তু উহা হইতে যতই উত্তর বা দক্ষিণে যাওয়া যায়, দিন ও রাত্রির সময়ের ব্যবধান ততই বাড়িতে থাকে। মেরু অঞ্চলের কোন কোন দেশের বৎসরের কোন কোন সময় দিন এত বড় হয় যে, ‘সন্ধা’ ও ‘ভোর’-এর মাঝখানে কোন রাত্রি নাই। সেখানে এশার নামাজের উপায় কি?
মেরু অঞ্চলে বৎসরে মাত্র একটি দিবা ও একটি রাত্রি হয় অর্থাৎ ছয় মাসকাল একাদিক্রমে থাকে দিন এবং ছয় মাসকাল রাত্রি। ওখানে বৎসরে হয়ত পাঁচবার (পাঁচ ওয়াক্ত) নামাজ পড়া যায়, কিন্তু একমাস রোজা রাখা যায় কি রকমে?
৬। নাপাক বস্তু কি আল্লাহর কাছেও নাপাক?
পৃথিবীর দ্রব্যাদির মধ্যে কতক দ্রব্য ধর্মীয় বিধানে নাপাক (অপবিত্র)। কিন্তু সে সকল কি আল্লাহর কাছেও নাপাক? যদি তাহাই হয়, তবে তাহা তিনি সৃষ্টি করিলেন কেন? আর যদি না হয়, তবে নাপাক অবস্হায় তাঁহার গুণগান করিলে তাহা তিনি অগ্রাহ্য করিবেন কেন? বলা হয় যে, আল্লাহ সর্বত্র বিদ্যমান। যদি তাহাই হয়, তবে নাপাক বস্তুর ভিতরে আল্লাহর অবস্হিতি নাই কি?
৭। উপাসনায় দিগনির্ণয় কেন?
সাকার উপাসকগণ তাঁহাদের আরাধ্য দেবতার দিকে মুখ করিয়া উপাসনা করিয়া থাকেন। যেমন কালী দেবীকে স্হাপন করা হয় দক্ষিণমুখী করিয়া এবং দুর্গাদেবীকে পশ্চিমমুখী। তাই পূজারীকে বসিতে হয় যথাক্রমে উত্তর ও পূর্বমুখী হইয়া। কিন্তু এই দিগনির্ণয় কেন, তাহা আমরা জানি না। বলা হইয়া থাকে যে, আল্লাহ নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। তাহাই যদি হয়, তবে নিরাকার উপাসনায় কেবলার আবশ্যক কি এবং হাত তুলিয়া মোনাজাত কেন? ইহাতে আল্লাহর দিগবিশেষে স্হিতির সংকেত হয় কি না!
৮। ফেরেস্তা কি?
আমরা শুনিয়া থাকি যে, আল্লাহ নিরাকার। কিন্তু নিরাকার মাত্রই আল্লাহ নহে। বিশ্বব্যাপী ইথার (Ether) নিরাকার। কিন্তু ইথারকে কেহ ঈশ্বর বলে না। কেননা আকারবিহীন হইলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং উহার মধ্যে পদার্থের গুণও পাওয়া যায়। বিশেষত ইথার নিরাকার হইলেও চেতনাবিহীন। পদার্থ যতই সূক্ষাতিসূক্ষ হউক না কেন, উহার অস্তিত্ব এবং স্হিতি আছে। এমন কোন পদার্থ জগতে পাওয়া যায় নাই, যাহার অস্তিত্ব যন্ত্র বা ইন্দ্রিয়ানুভুতির বাহিরে। শোনা যায় যে, ফেরেস্তা নামক এক জাতীয় জীব আছে এবং উহারা স্বর্গ-মর্ত্য সর্বত্র, এমনকি মানুষের সহচররুপেও বিচরণ করে। অথচ মানুষ উহাদের সন্ধান পায় না। উহারা কি কোন পদার্থের তৈয়ারী নয়? যদি হয়, তবে কোন অদৃশ্য বস্তুর দ্বারা তৈয়ারী? তাহা কিন ঈশ্বর হইতেও সূক্ষ? হইলে তাহা কি? আর যদি কোন পদার্থের তৈয়ারী না হয়, তবে কি তাহারা নিরাকার?
আল্লাহ নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম এক মহাশক্তি। পক্ষান্তরে নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম আর একটি সত্তাকে ফেরেস্তা বলিয়া স্বীকার করিলে আল্লাহ অতুলনীয় থাকেন কিরূপে?
কেহ কেহ বলেন যে, ফেরেস্তারা নূরের তৈয়ারী। নূর বলিতে সাধারণত বুঝা যায় যে, আলো বা রশ্মি। সাধারণ আলো অদৃশ্য নয়, উহা দৃশ্যমান পদার্থ। কিন্তু বিশ্বে এমন কতকগুলি বিশেষ আলো বা রশ্মি আছে, যাহা চক্ষে দেখা যায় না। যেমন – আলফা রশ্মি, কসমিক রশ্মি ইত্যাদি। বিজ্ঞানীগণ নানা কৌশলে ইহাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন এবং ইহাদের গুণাগুণও প্রমাণ করিতে সক্ষম হইয়াছেন্ কিন্তু বিজ্ঞানীগণ উহার কোন রকম রশ্মির দ্বারা তৈয়ারী ফেরেস্তার সন্ধান পাইতেছেন না। ফেরেস্তারা কোন জাতীয় রশ্মির (নূরের) দ্বারা তৈয়ারী?
৯। ফেরেস্তার কাজ কি?
পবিত্র কোরান ও বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনায় জানা যায় যে, স্বয়ং খোদাতা’লার হুকুমে সব সৃষ্টি হইয়া গেল। সৃষ্টিকার্য সম্পাদনে আল্লাহ কোন ফেরেস্তার সাহায্য লন নাই। যিনি সৃষ্টি করিতে পারেন, তিনি তাহা রক্ষা বা পরিচালনাও করিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বসংসারের নানাবিধ কার্য সম্পাদন করিবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বও খোদাতা’লা অসংখ্য ফেরেস্তা সৃষ্টি করিলেন কেন? শোনা যায় যে, ফেরেস্তাগণের নিজ ইচ্ছামত কাজ করিবার ক্ষমতা নাই। যদিও বিভিন্ন কাজ করিবার জন্য বিভিন্ন ফেরেস্তা নিযুক্ত আছেন তথাপি তাঁহার আল্লাহর আদেশ ভিন্ন কোন কাজই করিতে পারেন না। বিশ্বর যাবতীয় কার্য নির্বাহের জন্য প্রত্যেক ফেরেস্তাকেই যদি আল্লাহর হুকুম দিতে হয়, তবে তাঁহার ব্যস্ততা কমিল কি? কথিত হয় যে, অসংখ্য ফেরেস্তার মধ্যে প্রধান ফেরেস্তা চারিজন। যথা – জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ও আজ্রাইল। ইহাদের কার্যাবলী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।
ক. জিব্রাইলঃ-
– এই ফেরেস্তা নাকি পয়গম্বরের নিকট খোদাতালার আদেশ পৌঁছাইতেন। হজরত মোহাম্মদ (দ.) দুনিয়ার শেষ পয়গম্বর। তাঁহার বাদে নাকি আর কোন নবী জন্মিবেন না। কাজেই জেব্রাইল ফেরেস্তাও আর দুনিয়ায় আসিবেন না। তবে কেন কেহ কেহ বলেন যে, নির্দিষ্ট কয়েকবার আসিবেন। সে যাহা হউক, জেব্রাইল ফেরেস্তা বর্তমানে কোন কাজ করেন কি? মনো বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, জেব্রাইল সম্মোহন বিদ্যা (Hyptonism) আয়ত্ত করিতে পারিলে তাহার দুরদুরান্তে অবস্হিত কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে মানসিক ভাবের আদান-প্রদান করা যায়। উহাকে (Telepathy) বলে। সর্বশক্তিমান খোদাতালা এই টেলিপ্যাথির নিয়মে নবীদের সাথে নিজেই কথাবার্তা বলিতে পারিতেন। কিন্তু তাহা না করিয়া তিনি ফেরেস্তা সৃষ্টি করিয়া তাঁহার মারফত নবীদের কাছে আদেশ পাঠাইয়াছেন কেন?
খ. মেকাইলঃ-
– শোনা যায়, মেকাইল ফেরেস্তা নাকি মানুষের রেজেক বা খাদ্য বন্টন করেন। ‘খাদ্যবন্টন’ বলিতে সাধারণ মানুষের খাদ্যই বোঝায়। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী যথা – পশু, পাখী, কীট-পতঙ্গ ও বিভিন্ন জাতীয় জীবাণুদের খাদ্যবন্টন করেন কে, অর্থাৎ মেকাইল ফেরেস্তা না স্বয়ং খোদাতালা? অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্যবন্টন যদি স্বয়ং খোদাতালাই করেন, তবে মানুষের খাদ্যবন্টন তিনি করেন না কেন? আর যদি যাবতীয় জীবের খাদ্যই মেকাইল বন্টন করেন, তবে জগতের অন্য কোন প্রাণীকে নীরোগ দেহে শুধু উপবাসে মরিতে দেখা যায় না, অথচ মানুষ উপবাসে মরে কেন? আর মেকাইল ফেরেস্তা যদি শুধু মানুষের খাদ্যবন্টন করেন তবে মানুষের মধ্যে খাদ্যবন্টনে এতোধিক পার্থক্য কেন? হয়ত কেহ নিয়মিত পক্ষামৃত (দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, মধু, চিনি) আহার করেন, অন্যত্র কেহ জলভাতে শুধু লবণ ও লঙ্কাপোড়া পায় না। মেকাইলের এই পক্ষপাতিত্ব কেন? মেকাইল ফেরেস্তা নাকি বিশ্বপতির আবহাওয়া বিভাগও পরিচালনা করেন। কিন্তু এই বিভাগেও তাঁহার যোগ্যতা বা নিরপেক্ষতার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে না। অতীতকালে যাহাই হইয়া থাকুক না কেন, বর্তমানে ব্যাপকভাবেই পৃথিবীতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়াছে এবং বিভিন্ন দেশের নেতাগণ তাঁহাদের নিজ নিজ দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত পতিত জমি আবাদ কর্মে মনোযোগ দিয়াছেন। কিন্তু সসীম ক্ষমতার জন্য সকল ক্ষেত্রে কার্যকৃত হইতে পারিতেছেন না। অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন মেকাইল ফেরেস্তার অসাধ্য কিছুই নই। পৃথিবীর উত্তরও দক্ষিণ মেরুদেশের সঙ্গে যদি সাহারা মরুপ্রদেশের তাপ বিনিময় করিয় যথারীতি বৃষ্টিপাত ঘটান যাইত, তাহা হইলে লক্ষ লক্ষ একর জমি চাষাবাদ ও ফসল উৎপাদনের যোগ্য হইত এবং তাহাতে দুনিয়ার খাদ্যসংকট কতকাংশে কমিয়া যাইত। মেকাইল ফেরেস্তা উহা করিতে পারেন কি না? যদি পারেন, তবে উহা তিনি করেন না কেন/
শোনা যায়, আরবদেশ বিশেষত মক্কা শহর নাকি খোদাতালার খুব প্রিয় স্হান। কেননা দুনিয়ার প্রায় যাবতীয় পয়গম্বর আরব দেশেই জন্মিয়াছিলেন এবং শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (দ.) পবিত্র মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই আরবদেশে বৃষ্টিপাত ও চাষাবাদ নাই বলিলেই চলে। কিন্তু খোদাতালার অপ্রিয় দেশ ভারতবর্ষে বিশেষত আসামের চেরাপুন্জিতে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় কেন?
ভারত-বাংলার কথাই ধরা যাক। কাশী হিন্দু জাতির একটি তীর্থস্হান ও নানাবিধ দেবদেবীর প্রতিমার জাদঘর এবং চট্টগ্রামে মুসলিম বারো আওলিয়ার দরগাহ। এই কাশীর উপর না হইয়া চট্টগ্রামের উপর এতোধিক ঝড়-বন্যা হয় কেন? দেখা যায় যে, পৃতিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে তাপ, বায়ুপ্রবাহ, মেঘ-বৃষ্টির অত্যধিক পরিমাণে বৈষম্য আছে। ইহার কারণ কি ঐ সকল অঞ্চল ও তাহার নিকটবর্তী সাগর-পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্হান, না মেকাইলের পক্ষপাতিত্ব?
গ. এস্রাফিলঃ-
– এই ফেরেস্তা নাকি শিঙ্গা (বাঁশী) হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। খোদাতালার হুকুমে যখন ঐ শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন, তখনই মহাপ্রলয় (কেয়ামত) হইবে এবং পুন: যখন খোদাতালার হুকুমে ফুঁক দিবেন, তখন হাশর ময়দানাদি পুন: সৃষ্টি হইবে। আদিতে খোদাহালার হুকুমেই যদি বিশ্ব-সৃষ্ট হইতে পারিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার হুকুমে ধ্বংস হইতে পারিবে না কেন? যদি পারে, তবে এস্রাফিলের শিঙ্গা ফুঁকিবার আবশ্যক কি? আবার – প্রথমবারে বিশ্বসৃষ্টি খোদাতালার হুকুমে হইতে পারিল, কিন্তু মহাপ্রলয়ের পরে পুন: হাশর ময়দানাদি সৃষ্টির জন্য শিঙ্গার ফুঁক লাগিবে কেন?
শোনা যায় যে, অনন্ত অতীতকাল হইতে এস্রাফিল ফেরেস্তা শিঙ্গা হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন এবং শেষ দিন (কেয়ামত) পর্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিবেন। অথচ এত অধিককাল দাঁড়াইয়া থাকিয় শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন মাত্র দুইটি। কেয়ামতের নির্দিষ্ট তারিখটি আল্লাহ জানেন না কি? জানিলে এস্রাফিল ফেরেস্তাকে এতকাল পূর্বে শিক্ষা হাতে দিয়া দাঁড় করিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি?
ঘ. আজ্রাইলঃ-
– যমদূত জীবের জীবন হরণ করেন, এই কথাটি হিন্দুদের বেদে বর্ণিত আছে এবং উহারই ধর্মান্তরে নামান্তর ‘আজ্রাইল ফেরেম্তা’। আজ্রাইল ফেরেম্তা যে মানুষর জীবন হরণ করেন, তাহার পরিষ্কার ব্যাখ্যা শোনা যায ধর্মপ্রচারকদের কাছে। কিন্তু উহাতে মৃত্যু সম্পর্কে অনেক প্রশ্নই অজ্ঞাত থাকিয়া যায়। গরু, ঘোড়া, বাঘ, মহিষাদি, পশু, কাক, শকুনাদী, পাখি, হাঙ্গর-কুমিরাদী জলজ জীব ও কীট-পতঙ্গাদির জীবণ হরণ করাও কি আজ্রাইলের কাজ? নানাজাতীয় জীবদেহের ভিতরে ও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এত অধিক ক্ষুদ্র জীবাণু বাস করে যে, তাহার সংখ্যা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন। বিশেষত ঐ সকল জীবের পরমায়ুও খুব বেশী নয়, কয়েক মাস হইতে কয়েক ঘন্টা বা মিনিট পর্যন্ত। উহাদের জীবনও কি আজ্রাইল হরণ করেন? আম, জাম, তাল, নারিকেলাদি উদ্ভিদের জন্ম-মৃত্যু আছে বলিয়া লোকে বহুকাল পূর্ব হইতেই জানিত। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ বলেন যে, শুধু তাহাই নহে, উদ্ভিদের ক্ষুধা, পিপাসা, সুখ-দু:খ, স্পর্শানুভূতি, এমনকি শ্রবণশক্তিও আছে। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয় যন্ত্র দ্বারা প্রমাণ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, গাছের নিকট গান-বাজনা হইলে উহাদের মন প্রফুল্ল হয়। সুতরাং উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবের জীবন-এ কোন পার্থক্য নাই। এই গাছের জীবন হরণ করেন কে? ইহা ভিন্ন অতিক্ষুদ্র এক জাতীয় উদ্ভিদ আছে, উহাকে বীজাণু বলা হয়। ইহারা অতিশয় ক্ষুদ্র বলিয়া খালি চোখে দেখা যায় না। ইহারা বায়ুমন্ডলে ভাসিয়া বেড়ায় এবং উপযুক্ত পরিবেশ পাইলে নানারুপে আত্ম প্রকাশ করে। যেমন শেওলা, বাইছা, ব্যাঙের ছাতা, সিঁধুল ইত্যাদি। ইহাদের জন্ম এবং মৃত্যু আছে। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?
এমন অনেক জাতের জীবাণু বা বীজাণু আছে যাহার জীবদেহে বিশেষত মানুষের দেহে প্রবেশ করিয়া নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে। উহাদের আকার এত ক্ষুদ্র যে, রোগীর দেহের প্রতি ফোঁটা রক্তে লক্ষ লক্ষ জীবাণু ও বীজাণু থাকে এবং যথাযোগ্য ঔষধ প্রয়োগে অল্প সময়ের মধ্যেই উহারা মারা যায়। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?
মানুষা ভিন্ন অন্যান্য যাবতীয় জীবের জীবনে যদি আল্লাহতালার আদেশেই উড়িয়া যায়, তবে মানুষের জন্য যমদূত কেন? আর বিশ্বজীবের যাবতীয জীবন যদি আজ্রাইল একাই হরণ করেন, তবে তাঁহার সময় সংকুলান হয় কিরুপে? আজ্রাইলের কি বংশবৃদ্ধি হয়? অথবা আজ্রাইলের সহকারী (Assistant) আজ্রাইল আছে কি? থাকিলে – তাহার কি এককালীন সৃষ্টি হইয়াছে, না জগতে জীববৃদ্ধির সাথে সাথে নূতন-নূতন আজ্রাইল সৃষ্টি হইতেছে?
সর্বশেষ প্রশ্ন এই যে, যমদূতই যদি জীবনের হরণ করেন, তবে ‘কারণে মরণ’ হয় কেন? অর্থাৎ রোগ, দুর্ঘটনা ইত্যাদি কোন কারণ ব্যতীত জীবের মৃত্যু হয় না কেন?
প্রকাশ আছে যে, আলোচ্য ফেরেস্তা চতুষ্টয় ভিন্ন আরও চারিজন ফেরেস্তা আছেন, যাঁহারা প্রত্যেক মানুষের সহিত সংশ্লিষ্ট। উহারা হইলেন – কোরামান ও কাতেবীন এবং মনকির ও নকিন। উহাদের সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাইতেছে।
ঙ. কোরমান ও কাতেবীনঃ-
– ধর্মযাজকগণ বলিযা থাকেন যে, মানুষের সৎ ও অসৎ কাজের বিবরণ লিখিয়া রাখিবার জন্য প্রত্যেক মানুষের কাঁধের উপর কোরমান ও কাতেবীন নামক দুইজন ফেরেস্তা বসিয়া আছেন। উহাদের একজন লেখেন সৎকাজের বিবরণ এবং অপরজন অসৎ কাজের বিবরণ। এই ফেরেস্তাদ্বয়ের লিখিত বিবরণ দেখিয়া মানুষের পাপ ও পুণ্যের বিচার হইবে। মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াই কোন শিশু পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয় না। কেননা তখন তাহাদের ন্যায় বা অন্যায়ের কোন জ্ঞান থাকে না। বলা হইয়া থাকে যে, নাবালকত্ব উত্তীর্ন না হওয়া পর্যন্ত কোন মানুষের উপর নামাজ ও রোজা ফরজ হয় না।
মানুষ সাবালক হইবার নির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। শৈশব উত্তীর্ণ হইয়া কৈশোরে পদার্পণ ও কৈশোর পার হইয়া যৌবনে পদাপর্ণ, ইহার কোনটিই একদিনে হয় না। মানুষ সাবালক হইবার বয়স – কেহ বলেন ১২ বৎসর, কেহ বলেন নারীর ১৪ ও পুরুষের ১৮ বৎসর ইত্যাদি। এমতাবস্হায় কেরামান ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় কাঁধে আসেন কোনসময়? শিশু ভূমিষ্ঠ হইবার পরমুহূর্তে না সাবালক হইবার পর? শিশুর জন্মমুহূর্তের পর হইতে আসিলে ফেরেস্তাদের বেশ কয়েক বৎসর কর্মহীন অবস্হায় বসিয়া দিন কাটাইতে হয়। পক্ষান্তরে মানুষ সাবালক হইবার সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। ঐ বিষয়ে ঈশ্বরানুমোদিত সার্বজনীন কোন তারিখ আছে কি?
শোনা যায় যে, ফেরেস্তারা নাশাক ও দুর্গন্ধময় স্হানে থাকেন না বা উহা পছন্দ করেন না। তাই ফেরেস্তাদের মনোরন্জনের জন্য কেহ কেহ পাক সাফ থাকেন ও খোশবু ব্যবহার করেন। ধর্মীয় মতে অমুসলমান মাত্রই নাপাক। যেহেতু উহারা যথারীতি ওজু গোসল করে না, হারাম দ্রব্য ভক্ষণ করে, এমনকি কেহ কেহ মলত্যাগ করিয়া জলশৌচও কর না। আবার ডোম, মেথর ইত্যাদি অস্পৃশ্য জাতি নাপাক ও দুর্গন্ধেই ডুবিয়া থাকে। উহাদের কাঁধে ফেরেস্তা থাকেন কি না?
যে কোন মানুষের মৃত্যুর পর তাহার কাঁধের ফেরেস্তাদের কার্যকাল শেষ হইয়া যা। অত:পর তাঁহারা কি করেন? অর্থাৎ, কোন ঊর্ধ্বতন ফেরেস্তা বা আল্লাহতালার নিকট তাঁহার নথিপত্র বুঝাইয়া দিয়া অবসর জীবন যাপন করেন, না নিজ জিম্মায় কাগজপত্র রাখিয়া উহার হেফাজতে দিন কাটান, না অন্য কোন মানুষের কাঁধে বসিয়া কাজ শুরু করেন?
শোনা যায় যে, ফেরেস্তাদের নির্দিষ্ট সংখ্যা নাই এবং থাকিলেও তাহা আল্লাহ ব্যতীত আর কেহ জানে না। উহাদের মধ্য হইতে শুধুমাত্র কেরামন ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় ব্যতীত আর কোন ফেরেস্তার সহিত মানুষের ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা নাই। বাকিদের মধ্যে মাত্র আজ্রাইল ফেরেস্তা কাছে আসেন একদিন, তাহা অন্তিমকালে এবং মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মানুষের চির সহচর। হাঁটিতে, বসিতে, ভোজনে, শয়নে সবসময়ই উহারা মানুষের পার্শ্বচর। বিশেষত উহাদের অবস্হান মানুষের চক্ষু ও কর্ণ হইতে চারি-পাঁচ ইঞ্চির বেশী দূরে নয়। অথচ মানুষ উহাদের গতিবিধি দেখিতে, শুনিতে, অথবা অস্তিত্বকেই অনুভব করিতে পারে না। ইহার কারণ কি?
মানুষের কার্যবিবরণী ফেরেস্তাগণ যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, উহাতে কালি, কলম ও কাগজ বা অনুরূপ অন্য কিছু আবশ্যক। আলোচ্য বিবরণগুলি যদি বাস্তব হয়, তবে উহা লিখিবার উপকরণও হওয়া উচিত পার্থিব। অথচ মানুষ উহার কোন কিছুরই সন্ধান পায় না। উহার বাস্তবতার কোন প্রমাণ আছে কি? যদি না থাকে, তাহা হইলে – যখন ফেরেস্তারা অদৃশ্য, কালি অদৃশ্য, কলম এবং কাগজও অদৃশ্য, তখন বিবরণগুলি ঐরুপ নয় কি?
চ. মনকির ও নকিরঃ-
কথিত হয় যে, মানুষ কবরস্হ হইবার কিছুক্ষণ পরই ‘মনকির’ ও ‘নকির’ নামক দুইজন ফেরেস্তা আসিযা মৃতকে পুনর্জীবিত করেন ও তাহাকে ধর্ম-বিষয়ে কতিপয় প্রশ্ন করেন। সদুত্তর দিতে পারিলে তাহার সুখের অবধি থাকে না। কিন্তু তাহা না পারিলে তাহার উপর হয় নানারুপ শাস্তি। গুজের (গদার) আঘাতে ৭০ গজ মাটির নীচে প্রৌথিত হয়ে যায়, আবার ঐ ফেরেস্তার নখর দ্বারা তুলিয়া তাহাকে পুনরাঘাত করিতে থাকেন এবং সুড়ঙ্গপথে দোজখের আগুন আসিয়া পাপাত্মা মৃতকে জ্বালাইতে থাকে ইত্যাদি। কোন বিশেষ কারণ না থাকিলে সচরাচর মৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যেই কবরস্হ করা যায়। ঐ সময়ের মধ্যে মৃতদেহের মেদ, মজ্জা ও মাংসাদির বিশেষ কোন বিকৃতি ঘটে না। এই সময়ের মধ্যেই যদি সে পুনর্জীবন লাভ করিয়া সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়, তবে তাহার সেই নবজীবন হয় বিগত জীবনের অনুরূপ। কেননা দেখা যায় যে, সর্পঘাত, উগ্র মাদকদ্রব্য সেবন, ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ, কতিপয় রোগ, গভীর নিদ্রা ইত্যাদিতে মানুষের সংজ্ঞালোপ ঘটে। এইরুপ সংজ্ঞাহীনতা কয়েক ঘন্টা হইতে কয়েক দিন, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সপ্তাহকাল স্হায়ী হইতে দেখা যায়। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই সংজ্ঞাপ্রাপ্তির পর কাহারো পূর্বস্মৃতি লোপ পাইতে দেখা বা শোনা যায় নাই। কেননা মগজস্হিত কোষসমূহে (Cell) বিকৃতি না ঘটিলে কোন মানুষের স্মৃতি বা জ্ঞানের ভাবান্তর ঘটে না। তাই কাহারো ভাষারও পরিবর্তন ঘটে না।
হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক – দেহের এই তিনটি যন্ত্রের সুষ্ঠু ক্রিয়ার যৌথ ফলই হইল জীবনীশক্তি। উহার যে কোন একটা বা দুইটির ক্রিয়া সাময়িক লোপ পাওয়াকে ‘রোগ’ বলা হয়। কিন্তু ঐ তিনটির ক্রিয়া একযোগে লোপ পাওয়াকে বলা হয় মৃত্যু। শরীর বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, উক্ত যন্ত্রত্রয়ের একটি বা দুইটি নিষ্ক্রিয় (মৃত্যু) হইলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত তাহাও সক্রিয় করা সম্ভব হইবে। তাহাই যদি হয়, তবে কোন মৃত বাঙ্গালী পুনর্জীবিত হইলে সে কি ফরাসী ভাষায় কথা বলিবে, না, বাংলা ভাষায়?
পৃথিবীতে প্রায় ৩৪২৪টি বোধগম্য ভাষা আছে এবং অধিকাংশ মানুষই মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা জানে না। কাজেই কোন মৃতকে পুনর্জীবিত করা হইলে, অধিকাংশই তাহার মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় কথা বলিবার বা বুঝিবার সম্ভাবনা নাই। এমতাবস্হায় মনকিন ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মৃতকে প্রশ্ন করেন কোন ভাষায় – ফেরেস্তী ভাষায়, না মৃতের মাতৃভাষায়?
কেহ কেহ বলেন যে, হাশর ময়দানাদি পরলৌকিক জগতের আন্তর্জাতিক ভাষা হইবে আরবী, বোধহয় ফেরেস্তাদেরও। হাশর, ময়দানাদি পরজগতেও যদি পার্থিব দেহধারী মানুষ সৃষ্টি হয়, তবে তাহা হইবে এক অভিনব দেহ। কাজেই তাহাদের অভিনব ভাষার অধিকারী হওয়াও অসম্ভব নহে। কিন্তু মৃতের কবরস্হ দেহ অভিনব নয়, উহা ভূতপূর্ব। এক্ষেত্রে সে অভিনব (ফেরেস্তী বা আরবী) ভাষা বুঝিতে বা বলিতে পারে কিভাবে?
পক্ষান্তরে, যদি ফেরেস্তারা আঞ্চলিক ভাষায়ই প্রশ্ন করেন, তাহা হইলে ভিন্ন ভিন্ন ৩৬২৪ টি ভাষাভাষী ফেরেস্তা আবশ্যক। বাস্তবিক কি তাহাই?
ধর্মীয় বিবরণ মতে, পরলৌকিক ঘটনাবলীর প্রায় সমস্তই মানুষের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বাহিরে। কিন্তু ‘গোর আজাব’ – এই ঘটনাটি যদিও পরলোকের অন্তর্ভূক্ত, তথাপি উহার অবস্হান ইহলোকে অর্থাৎ এই পৃথিবীতেই। বিশেষত উহা মানুষের অবস্হান হইতে বেশী দূরেও নয়। বড় বড় শহরের গোরস্হানগুলি ছাড়া গ্রামাঞ্চলের কবরগুলি প্রায়ই থাকে বাসস্হানের কাছাকাছি এবং উহার গভীরতাও বেশী নয়, মাত্র ফুট তিনেকের মত। ওখানে বসিয়া ফেরেস্হা ও পুনর্জীবিত ব্যক্তির মধ্যে যে সকল কথাবার্তা, মারধোর, কান্নাকাটি ইত্যাদি কাহিনী হয়, অতি নিকটবর্তী মানুষও তাহা আদৌ শুনিতে পায় না কেন?
দেখা যাইতেছে যে, হত্যা সম্পর্কিত মামলাদিতে কোন কোন ক্ষেত্রে মৃতকে কবর দেওয়ার তিন-চারদিন বা সপ্তাহকাল পরে কবর হইতে তুলিয়া নেওয়া হয় এবং উহা অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ পরীক্ষা করিয়া থাকেন। কিন্তু যত বড় দুর্দান্ত ব্যক্তির লাশই হউক না কেন, কোন ডাক্তার উহার গায়ে গুর্জের আঘাতের দাগ বা আগুনে পোড়ার চিহ্ন পান নাই। অধিকন্তু খুব লক্ষ্য করিয়া দেখা গিয়েছে যে, মুর্দাকে যেইভাবে কবরে রাখা হয়েছিল, সেইভাবেই আছে, একচুলও নড়চড় হয় নাই। বিশেষত কবরের নিম্নদিকে ৭০ গজ গর্ত বা কোন পার্শ্বে (দোজখের সঙ্গে) সুড়ঙ্গ নাই। ইহার কারণ কি? গোর আজাবের কাহিনীগুলি কি বাস্তব, না অলীক?
এ কথা সত্য যে, কোন মানুষকে বধ করার চেয়ে প্রহার করা সহজ এবং সবল ব্যক্তির চাইতে দূর্বল ব্যক্তি বধ করা সহজ। রেল, জাহাজ, বিমান ইত্যাদির আকস্মিক দুর্ঘটনায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এক মুহূর্তে শত শত সুস্হ ও সবল মানুষ বধ করেন আজ্রাইল ফেরেস্তা একা। আর রুগ্ন, দুর্বল ও অনাহারক্লিষ্ট মাত্র একজন মানুষকে শুধু প্রহার করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তা কেন? পক্ষান্তরে শুধুমাত্র মৃতকে প্রশ্ন করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তার আবশ্যিকতা কিছু আছে কি?
জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ইত্যাদি নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম (Proper Noun)। কিন্তু কেরামন, কাতেবিন, মনকির ও নকির – এই নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম নয়, সম্প্রদায় বা শ্রেণীগত নাম (Common Noun)। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ জীবিত আছে।* তাহা হইলে সমস্ত মানুষের কাঁধে কেরামন আছে ৩০০ কোটি এবং কাতেবীন ৩০০ কোটি, জানিনা মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয়ের সংখ্যাও ঐরুপ কিনা। সে যাহা হউক, উহাদের ব্যক্তিগত কোন নাম আছে কি? না থাকিলে উহাদের কোন বিশেষ ফেরেস্তাকে আল্লাহ তলব দেন কি প্রকারে?
১০. দূরত্বহীন যাতায়াত কি সম্ভব?
শোনা যায় যে, স্বর্গীয় দূত জেব্রাইল আল্লাহর আদেশ মত নবীদের নিকট অহি (বাণী) লইয়া আসিতেন এবং তাহা নাজেল (অর্পণ) করিয়া চলিয়া যাইতেন। আসা ও যাওয়া – এই শব্দ দুইটি গতিবাচক এবং গতির আদি ও অন্তের মধ্যে দূরত্ব থাকিতে বাধ্য। আল্লাহতালা নিশ্চয়ই নবীদের হইতে দূরে ছিলেন না। তবে কি জেব্রাইলের আসা ও যাওয়া দূরত্বহীন? আর দূরত্ব থাকিলে তাহার পরিমাণ কত (মাইল)?
১১. মেরাজ কি সত্য, না স্বপ্ন?
শোনা যায় যে, হজরত মোহাম্মদ (দ.) রাত্রিকালে আল্লাহর প্রেরিত বোরাক নামক এক আশ্চর্য জানোয়ারে আরোহণ করিয়া আকাশভ্রমণে গিয়াছিলেন। ঐ ভ্রমণকে মেয়ারাজ বলা হয়। তিনি নাকি কোটি কোটি বৎসরের পথ অতিক্রম করিয়া আরশে পৌঁছিয়া আল্লাহর সহিত কথোপকথন করিয়াছিলেন এবং আল্লাহ তাঁহাকে ইসলামের দুইটি মহারত্ন নামাজ ও রোজা উপহার দিয়াছিলেন। ঐ রাত্রে তিনি বেহেস্ত-দোজখাদিও পরিদর্শন করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। ইহাতে নাকি তাঁহার সময় লাগিয়াছিল কয়েক মিনিট মাত্র। কথিত হয় যে, মেয়ারাজ গমনে হজরত (দ.)-এর বাহন ছিল – প্রথম পর্বে বোরাক ও দ্বিতীয় পর্বে রফরফ। উহারা এরুপ দুইটি বিশেষ জানোয়ার, যাহার দ্বিতীয়টি জগতে নাই। বোরাক – পশু, পাখী ও মানব এই তিন জাতীয় প্রাণীর মিশ্ররুপের জানোয়ার। অর্থাৎ তাহার ঘোড়ার দেহ, পাখীর মত পাখা এবং রমণীসদৃশ মুখমন্ডল। বোরাক কোন দেশ হইতে আসিয়াছিল, ভ্রমণান্তে কোথায় গেল, বর্তমানে কোথায়ও আছে, না মারা গিয়াছে, থাকিলে – উহার দ্বারা এখন কি কাজ করান হয়, তাহার কোন হদিস নাই। বিশেষত একমাত্র শবে মেয়ারাজ ছাড়া জগতে আর কোথাও ঐ নামটিরই অস্তিত্ব নাই। জানোয়ারটি কি বাস্তব না স্বপ্নিক?
হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন স্হাপত্যশিল্পের নিদর্শন পৃথিবীতে অনেক আছে। খৃ.পূ. তিন হাজার বৎসরেরও অধিককাল পূর্বে নির্মিত মিশরের পিরামিডসমুহ আজও অক্ষত দেহে দাঁড়াইয়া আছে। হজরতের মেয়ারাজ গমন খুব বেশীদিনে কথা নয়, মাত্র খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। ঘটনাটি বাস্তব হইলে – যে সকল দৃশ্য তিনি মহাশূণ্যে স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন (আরশ ও বেহেস্ত-দোজখাদি), তাহা আজও সেখানে বর্তনান থাকা উচিত। কিন্তু আছে কি? থাকিলে তাহা আকাশ-বিজ্ঞানীদের দূরবীনে ধরা পড়ে না কেন?
মেয়ারাজ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিতে হইলে প্রথম জানা আবশ্যক যে, হজরত (দ.) –এর মেয়ারাজ গমন কি পার্থিব না আধ্যাত্মিক; অর্থাৎ দৈহিক না মানসিক। যদি বলা হয় যে, উহা দৈহিক, তবে প্রশ্ন আসে – উহা সম্ভব হইল কিভাবে?
আকাশবিজ্ঞানীদের মতে – সূর্য ও গ্রহ-উপগ্রহরা যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে, তাহার নাম সৌরজগত, সূর্য ও কোটি কোটি নক্ষত্র মিলিয়া যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে তাহান নাম নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা এবং কোটি কোটি নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা মিলিয়া যে স্হান দখল করিয়া আছে, তাহার নাম নীহারিকাজগত।
বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, বিশ্বের যাবতীয় গতিশীল পদার্থের মধ্যে বিদ্যুৎ ও আলোর গতি সর্বাধিক। উহার সমতুল্য গতিবিশিষ্ট আর জগতে নাই। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল। আলো এই বেগে চলিয়া এক বৎসরে যতটুকু পথ অতিক্রম করিতে পারে, বিজ্ঞানীগণ তাহাকে বলেন এক আলোক বৎসর।
বিশ্বের দরবারে আমাদের এই পৃথিবী খুবই নগণ্য এবং সৌরজগতটিও নেহায়েত ছোট জায়গা। তথাপি এই সৌরজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে আলোক পৌঁছিতে সময় লাগে প্রায় ১১ ঘন্টা। অনুরূপভাবে, নক্ষত্রজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ৪০০০ কোটি আলোক বৎসর।১১ এই যে বিশাল স্হান, ইহাই আধুনিক বিজ্ঞানীদের পরিচিত দৃশ্যমান বিশ্ব। এই বিশ্বের ভিতরে বিজ্ঞানীরা বেহেস্ত, দোজখ বা আরশের সন্ধান পান নাই। হয়ত থাকিতে পারে ইহার বহির্ভাগে, অনন্ত দূরে। হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন যদি বাস্তব হয়, অর্থাৎ তিনি যদি সশরীরে একটি বাস্তব জানোয়ারে আরোহণ করিয়া সেই অনন্তদূরে যাইয়া থাকেন, তবে কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে আলোচ্য দূরত্ব অতিক্রম করা কিভাবে সম্ভব হইল? বোরাকে গতি সেকেন্ড কত মাইল ছিল?
বোরাকের নাকি পাখাও ছিল। তাই মনে হয় যে, সেও আকাশে (শূণ্যে) উড়িয়া গিয়াছিল। শূণ্যে উড়িতে হইলে বায়ু আবশ্যক। যেখানে বায়ু নাই, সেখানে কোন পাখী বা ব্যোমযান চলিতে পারে না। বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, প্রায় ১২০ মাইলের উপরে বায়ুর অস্তিত্ব নাই।১২ তাই তাঁহারা সেখানে কোনরুপে বিমান চালাইতে পারেন না, চালাইয়া থাকেন রকেট। বায়ুহীন মহাশূণ্যে বোরাক উড়িয়াছিল কিভাবে?
নানা বিষয় পর্যালোচন করিলে মনে হয় যে, হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন (আকাশভ্রমণ) সশরীরে বা বাস্তবে সম্ভব নহে। তবে কি উহা আধ্যাত্মিক বা স্বপ্ন?
এ কথায় প্রায় সকল ধর্মই একমত যে, ‘সৃষ্টিকর্তা সর্বত্র বিরাজিত’। তাহাই যদি হয়, তবে তাঁহার সান্নিধ্যলাভের জন্য দূরে যাইতে হইবে কেন? আল্লাহতালা ঐ সময় কি হযরত (দ.)-এর অন্তরে বা তাঁহার গৃহে, মক্কা শহরে অথবা পৃথিবীতেই ছিলেন না?
পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলিয়াছেন – তোমরা যেখানে থাক, তিনি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন।“ (সুরা হাদিদ – ৪)। মেয়ারাজ সত্য হইলে এই আয়াতের সহিত তাহার কোন সঙ্গতি থাকে কি?
১২. কতগুলি খাদ্য হারাম হইল কেন?
বিভিন্ন ধর্মমতে কোন কোন খাদ্য নিষিদ্ধ এবং কোন কোন দ্রব্য স্বাস্হ্য রক্ষার প্রতিকূল বলিয়া স্বাস্হ্যবিজ্ঞানমতেও ভক্ষণ নিষিদ্ধ। যে সকল দ্রব্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানি ঘটিতে পারে, তাহা নিষিদ্ধ হইলে বুঝা যায় যে, কেন উহা নিষিদ্ধ হইল। কিন্তু যে খাদ্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানির আশঙ্কা নাই, এমন খাদ্য নিষিদ্ধ (হারাম) হইল কেন?
১৩. এক নেকী কতটুকু?
স্হান, কাল, বস্তু ও বিভিন্ন শক্তি পরিমাপের বিভিন্ন মাপকাটি বা বাটখারা আছে। যথা – স্হান বা দূরত্বের মাপকাটি গজ, ফুট, ইঞ্চি, মিটার ইত্যাদি; সময় পরিমাপের ইউনিট ঘন্টা, মিনিট ইত্যাদি; ওজন পরিমাপের মণ, সের; বস্তু পরিমাপে গন্ডা, কাহন; তাপ পরিমাপে ডিগ্রি; আলো পরিমাপে ক্যান্ডেল পাওয়ার; বিদ্যুৎ পরিমাপে ভোল্ট, অ্যাম্পিয়ার ইত্যাদির ব্যবহার হয়। অর্থাৎ কোন কিছু পরিমাপ করিতে হইলেই একটি ইউনিট বা একক থাকা আবশ্যক। অন্যথায় পরিমাপ করাই অসম্ভব। কোন কোন ধর্মপ্রচারক বলিয়া থাকেন যে, অমুক কাজে ‘দশ নেকী’ বা অমুক কাজে ‘সত্তর নেকী’ পাওয়া যাইবে। এ স্হলে ‘এক নেকী’-এর পরিমাণ কতটুকু এবং পরিমাপের মাপকাটি কি?
১৪. পাপের কি ওজন আছে?
মানুষের মনের সুখ, দু:খ, ইচ্ছা, ঘৃণা, স্নেহ, হিংসা, দ্বেষ, অহঙ্কার ইত্যাদি কোন পদার্থ নহে, ইহারা মনের বিভিন্ন বৃত্তি মাত্র। ব্যক্তিভেদে এসবের তারতম্য লক্ষিত হয়। কাজেই বলিতে হয় যে, ইহাদেরও পরিমাণ আছে। কিন্তু পরিমাপক যন্ত্র নাই। কারণ ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাহিরে, সেই সমস্ত তৌলযন্ত্র বা নিক্তি দ্বারা মাপিবার চেষ্টা বৃথা। মনুষ্যকৃত ন্যায় ও ‘অন্যায়’ আছে এবং ইহারও তারতম্য আছে। কাজেই ইহারও পরিমাণ আছে। কিন্তু উহা পরিমাপ করিবার মত কোন যন্ত্র অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
‘অন্যায়’-এর পরিমাপক কোন যন্ত্র না থাকিলেও বিচারপতিগণ অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণকরত অন্যায়কারীকে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করিয়া থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিচারকগণ নান প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণপূর্বক অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেন, কোনরুপ যনত্র ব্যবহার না বা করিতে পারেন না।
কঠিন ও তরল পদার্থ ওজন করিবার জন্য নানা প্রকার তৌলযন্ত্র ও বাটখারা আছে। বর্তমান যুগে তৌলযন্ত্রের অভাবনীয় উন্নতি হইয়াছে। লন্ডন শহরের বৃটিশ ব্যাঙ্কে একটি তৌলযন্ত্র আছে। ভষারা (?? আমার বইয়ে পরিষ্কার নয়) নাকি একবারে একশত আশি মণ সোনা, রুপা বা অনুরুপ অন্যান্য দ্রব্যাদি ওজনে উহার কাঁটা দশ ইঞ্চি হেলিয়া পড়ে। তৌলযন্ত্রের এরুপ উন্নতি হইলেও – তাপ, আলো, কাল, দুরত্ব, বিদ্যুৎ ইত্যাদি উহা দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। যেহেতু ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। পূর্বেই বলিয়াছি যে, যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন শক্তির আওতার বাহিরে, তাহা তৌলযন্ত্র বা নিক্তি মাপিবার চেষ্টা বৃথা।
‘অন্যায়’-এর নামান্তর পাপ বা অন্যায় হইতেই পাপের উৎপত্তি। সে যাহা হউক, কোনরুপ তৌলযন্ত্র বা নিক্তি ব্যবহার করিয়া পাপের পরিমাণ ঠিক করা যা কিরূপে?
১৫. ইসলামের সাথে পৌত্তলিকতার সাদৃশ্য কেন?
আমরা শুনিয়া থাকি যে, সুসংস্কৃত ইসলামে কুসংস্কারের স্হান নাই। বিশেষত নিরাকার-উপাসক হইতে সাকার-উপাসকগণই অত্যধিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। যদিও বেদ বিশেষভাবে পুতুল-পূজা শিক্ষা দেয় নাই, তথাপি পরবর্তীকালে পুরাণের শিক্ষার ফলে বৈদিক ধর্ম ঘোর পৌত্তলিকতায় পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বৈদিক বা পৌত্তলিক ধর্মের সহিত ইসলাম ধর্মের অনেক সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়, যাহার ভাষা ও রুপগত পার্থক্য থাকিলেও ভাবগত পার্থক্য নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় বাদ দিলেও নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে উভয়ত সাদৃশ্য দেখা যায়। যথা –
১. ঈশ্বর এক – একমেবাদ্বিতীয়ম (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)।
২. বিশ্ব-জীবের আত্মাসমূহ এক সময়ের সৃষ্টি।
৩, মরণান্তে পরকাল এবং ইহকালের কর্মফল পরকালে ভোগ।
৪. পরকালের দুইটি বিভাগ – স্বর্গ ও নরক (বেহেস্ত-দোজখ)।
৫. স্বর্গ সাত ভাগে এবং নরক সাত ভাগে বিভক্ত। (কেহ কেহ বলেন যে, ইহা ভিন্ন আর একটি স্বর্গ আছে, উহা বাদশাহ শাদ্দাদের তৈয়ারী।)
৬. স্বর্গ বাগানময় এবং নরক অগ্নিময়।
৭. স্বর্গ উর্ধদিকে অবস্হিত।
৮. পুণ্যবানদের স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পাপীদের নরকবাস।
৯. যমদূত (আজ্রাইর ফেরেস্তা) কর্তৃক মানুষের জীবন হরণ।
১০. ভগবানের স্হায়ী আবাস ‘সিংহাসন’ (আরশ)।
১১. স্তব-স্তুতিতে ভগবান সন্তুষ্ট।
১২. মন্ত্র (কেরাত) দ্বারা উপাসনা করা।
১৩. মানুষ জাতির আদি পিতা একজন মানুষ – মনু (আদম)।
১৪. নরবলি হইতে পশুবলির প্রথা পচলন।
১৫. বলিদানে পুণ্যলাভ (কোরবাণী)।
১৬. ঈশ্বরের নাম উপবাসে পুণ্যলাভ (রোজা)।
১৭. তীর্থভ্রমণে পাপের ক্ষয় – কাশী-গয়া (মক্কা-মদিনা)।
১৮. ঈশ্বরের দূত আছে (ফেরেস্তা)।
১৯. জানু পাতিয়া উপাসনায় বসা।
২০. সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত (সেজদা)।
২১. করজোড়ে প্রার্থনা (মোনাজাত)।
২২. নিত্যউপাসনার নির্দিষ্ট স্হান – মন্দির (মসজিদ)।
২৩. মালা জপ (তসবিহ্ পাঠ)।
২৪. নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা করা – ত্রিসন্ধা (পাঁচ ওয়াক্ত)।
২৫. ধর্মগ্রন্হপাঠে পুণ্যলাভ।
২৬. কার্যারম্ভে ঈশ্বরের নামোচ্চরণ – নারায়ণৎ সমস্কতাং নবৈষ্ঞব নরোত্তমম (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম)।
২৭. গুরুর নিকট দীক্ষা (তাওয়াজ্জ)।
২৮. স্বর্গে গণিকা আছে – গন্ধর্ব, কিন্নরী, অপ্সরা (হুর-গেলমান)।
২৯. উপাসনার পুর্বে অঙ্গ ধৌত রা (অজু)।
৩০. দিগনির্ণয়পূর্বক উপাসনায় বসা বা দাঁড়ান।
৩১. পাপ-পুণ্য পরিমাপে তৌলযন্ত্র ব্যবহার (মিজান)।
৩২. স্বর্গস্বামীদের নদী পার হওয়া – বৈতরণী (পুলছিরাত) ইত্যাদি।
ঐ সমস্ত ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিধি-নিষেধেও অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়, সে সকল বিষয়ে চিন্তা করিলে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, হয়ত ইসলাম হইতে বিষয়গুলি পৌত্তলিকগণ গ্রহণ করিয়াছেন, নচেৎ পৌত্তলিকদের নিকট হইতে ইসলাম উহা গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে, পূর্ববর্তীগণের নিকট হইতে পরবর্তীগণ গ্রহণ করিয়াছে। পরবর্তী কাহারা?
টীকাসমূহ
১০. বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন, মু. আ. হাই, পৃষ্ঠা. ১৪১, ১৪২
১১. নক্ষত্র পরিচয়, প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা. ১৪, ১৬
১২. মহাকাশের ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ৯৫
* মূল পান্ডুলিপির রচনাকাল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ।
- See more at: http://ebanglalibrary.com/1799#sthash.ofHt9bmo.dpuf